আর্থ্রাইটিস! এর বিবরণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

  • রেজবুল ইসলাম 
  • এপ্রিল ১৯, ২০১৮

আর্থ্রাইটিস বলতে সাধারণত অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টের প্রদাহকেই বোঝানো হয়। এটি নির্দিষ্ট একটি রোগ নয়। অস্থিসন্ধি, অস্থিসন্ধির আশপাশের মাংসপেশি, টেনডন ইত্যাদির অনেকগুলো অসুখ একসঙ্গে আর্থ্রাইটিস নামে পরিচিত। তবে সবচেয়ে বেশি হয় অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কারণ, রিস্ক ফ্যাক্টও আলাদা ধরনের। সাধারণত অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ব্যথা হয় কোমর, হাঁটু ও হাতে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে হাতের কবজিসহ শরীরের অন্যান্য অংশে ব্যথা বেশি হয়, তুলনামূলকভাবে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা কম হয়।

অস্টিওআর্থ্রাইটিস কী? 

সাধারণত অস্টিওআর্থ্রাইটিস হঠাৎ করে হয় না। ধীরে ধীরে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করলে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনাআপনি অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হয়, এক বা একাধিক অস্থিসন্ধি ফুলে যায় ও ব্যথা করে, অস্থিসন্ধির জড়তা বা স্টিফনেস দেখা দেয় (সাধারণত ঘুম থেকে ওঠার পর বা দীর্ঘসময় বসে থেকে ওঠার সময়), ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রমের পর অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়, অস্থিসন্ধিতে কড়মড় শব্দ হয়।

অস্টিওআর্থ্রাইটিস বেশি হয় হাঁটুর জয়েন্টে। উঁচু কোথাও উঠতে গেলে হাঁটুতে বেশি চাপ লাগে। হাতে যদি ভারী কোনো বোঝা থাকে, তবে তা বহন করা কষ্টকর হয়। হাঁটু ফুলে যায়। কোমরে হলে নড়াচড়া করা কঠিন হয়। বিশেষ করে শরীরের নিচের অংশ। ব্যথা কোমরের সঙ্গে সঙ্গে কুঁচকি, উরু এমনকি হাঁটুতেও হতে পারে। হাতের মধ্যে বৃদ্ধাঙুলে বেশি হয়। আঙুলে ব্যথা হয়, ফুলে যায়, ঝিমঝিম করে, জয়েন্টের আশপাশে গোটার মতো গুটি হয়। মেরুদণ্ডে হলে ঘাড় ও কোমরে উভয় স্থানে ব্যথা হতে পারে। কখনো কখনো হাত-পা ঝিমঝিম করে।

যাদের ঝুঁকি বেশিঃ 

বেশি বয়স : বয়স ৬৫-র বেশি হলে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তবে যেকোনো বয়সেও হতে পারে। আবার অস্থিসন্ধিতে আঘাত পেলে যে কারো হতে পারে।

লিঙ্গ : বয়স ৪৫-এর আগে ছেলেদের বেশি হয়, ৪৫-এর পরে মেয়েদের বেশি হয়।

আঘাত : অস্থিসন্ধিতে যেকোনো ধরনের আঘাত পেলে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়ে। এ কারণে যারা পেশাগত কারণে শারীরিক পরিশ্রম বেশি করেন বা আঘাতের ঝুঁকিতে থাকেন, যেমন খেলোয়াড়, তাদের এ রোগ বেশি হয়।

বেশি ওজন : শরীরের ওজন যাদের বেশি অস্টিওআর্থ্রাইটিস তাদের বেশি হয়। সাধারণ স্থূল শরীরের মানুষের হাঁটুতে রোগটি বেশি দেখা দেয়।
বংশগত : কিছু ক্ষেত্রে বংশগত কারণেও অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে দেখা যায়।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস

এটি এক ধরনের অটোইমিউন অসুখ। এতে শরীরের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার কারণেই আপনাআপনি কিছু টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অস্থিসন্ধির বহিরাবরণীতে (সাইনোভিয়াম) প্রদাহ হয়। এ কারণে অস্থিসন্ধি ও এর আশপাশে ব্যথা হয়, জড়তা তৈরি হয়, ফুলে যায়, লাল হয়ে যায় এবং শরীরে জ্বরজ্বর অনুভূতি হয়। এতে অস্থিসন্ধির আকারের বিকৃতিও ঘটে। এটি যত দিন যায় আরো তীব্র হতে থাকে। মাঝেমধ্যে ব্যথা ও ফোলা আপনিতেই কমে যায়, আবার বাড়ে। অস্থিসন্ধি ছাড়াও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা যায় চোখ, ফুসফুস ও হার্ট।

লক্ষণ :

রোগটি দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক। তাই কখনো কখনো লক্ষণ প্রকাশ পায়, আবার কিছুদিন কোনো লক্ষণই থাকে না। সাধারণত লক্ষণ হিসেবে থাকে-

- ঘুম থেকে ওঠার পর প্রায় এক ঘণ্টা বা এর চেয়ে বেশি সময় অস্থিসন্ধিসহ শরীরের কিছু অংশে ব্যথা ও জড়তা (স্টিফনেস) থাকে।

- হাতের আঙুল, কনুই, কাঁধ, হাঁটু, গোড়ালি ও পায়ের পাতায় বেশি সমস্যা হয়।

- সাধারণত শরীরের উভয় পাশ একসঙ্গে আক্রান্ত হয়। যেমন- হাতে হলে দুই হাতের জয়েন্টই একসঙ্গে ব্যথা করে, ফুলে যায় ইত্যাদি।

- শরীর দুর্বল লাগে, জ্বরজ্বর অনুভূতি হয়। ম্যাজম্যাজ করে।

- কারো কারো ক্ষেত্রে ত্বকের নিচে এক ধরনের গুটি দেখা যায়, যা ধরলে ব্যথা পাওয়া যায় না।

আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা : আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা পাঁচটি ধাপে করা সম্ভব- ওষুধের মাধ্যমে, ব্যায়ামের মাধ্যমে, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে, বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগে এবং অপারেশনের মাধ্যমে। কখনো কখনো একই সঙ্গে একাধিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। ওষুধের মাধ্যমেই প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা শুরু করা হয়। সাধারণত ব্যথানাশক ও ক্যালসিয়ামজাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। এ ছাড়া আক্রান্ত অস্থিসন্ধির ব্যথা উপশমে ব্যথানাশক স্প্রে ও লোশনও ব্যবহার করা হয়। ব্যথানাশক ওষুধের মধ্যে আছে প্যারাসিটামল, আইবুপ্রফেন, এনএসএআইডি, নারকোটিক পেইনকিলার, কর্টিকোস্টেরয়েড, হায়ালুরোনিক এসিড সাবস্টিটিউট, ডিএমআরডিএস ইত্যাদি। একেকজনের ক্ষেত্রে একেক ওষুধ কার্যকরী। 

তাই নিজে নিজে ওষুধ সেবন না করে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত। ওষুধ ব্যথা ও প্রদাহ কমিয়ে দেয় কিন্তু পাকস্থলীতে এসিডিটি বা বুকজ্বলার সমস্যা করতে পারে। আর্থ্রাইটিসে বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম ও সেঁকের মাধ্যমেও চিকিৎসা করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর্থ্রাইটিস রোগীদের জন্য কী ধরনের ব্যায়াম করতে হবে, তা ডাক্তার শিখিয়ে দেন। ব্যায়ামের মধ্যে আছে মাসল স্ট্রেংদেনিং, অ্যারোবিক ইত্যাদি। ওজন নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আর্থ্রাইটিসের রোগীরা ভালো থাকতে পারেন। তাই কিছু কিছু খাবার, যা ওজন বাড়ায় তা এড়িয়ে চলুন। খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিন। বিকল্প চিকিৎসার মধ্যে আছে মেডিটেশন, ম্যাসাজ থেরাপি, হট অ্যান্ড কোল্ড থেরাপি। রোগটি যখন বেশি হয়, তখন অপারেশন প্রয়োজন হতে পারে। এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত অস্থিসন্ধি প্রতিস্থাপন করা লাগতে পারে। আশার কথা, এ ধরনের অপারেশন এখন দেশেই হচ্ছে।

 

Leave a Comment