আপনাদের মতো বাবারাই তো নিজের মেয়েদের ধর্ষণ করে, নাকি!

  • ফারজানা আক্তার 
  • মার্চ ১৫, ২০১৮

কোথায় যেন আমি এমন একটা লেখা পড়েছিলাম! কোথায় পড়েছিলাম মনে নেই তবে লেখাটা মনে আছে। লেখাটা এমন - এক লোক মেয়েদের পড়াশোনার বিপক্ষে। তিনি বিশ্বাস করেন মেয়েরা কাজ করবে ঘরে আর ছেলেরা বাহিরে। এই লোক বিয়ে করলেন এবং যথাসময়ে বাবা হতে যাচ্ছেন। তার বউয়ের প্রসব ব্যথা উঠেছে এবং ভাগ্যের নির্মম ইতিহাস পেটের ভিতরে বাচ্চা উল্টে গেছে। এই অবস্থায় দাই মায়েরা কিছু করতে পারবে না , তারা ওই লোকের বউকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললো। ওই লোক বউকে ঠিকই হাসপাতলে নিয়ে গেলো কিন্তু কোনো পুরুষ ডাক্তার দ্বারা বউকে চিকিৎসা করাতে রাজি তিনি নন! তিনি হাসপাতলে মেয়ে ডাক্তার খুঁজে বেড়াচ্ছেন। একজন লোক যিনি মেয়েদের পড়াশোনার বিপক্ষে তিনি একজন মেয়ে ডাক্তার খুঁজছেন! ব্যাপারটা কেমন হাস্যকর না?

যাই হোক এই ঘটনাটা সত্যি কিংবা মিথ্যা কিনা আমি জানি না! তবে মেয়েদের পড়াশোনার বিপক্ষে লোক কয়েক লক্ষ আছে সেটা আমি জানি। যারা মেয়েদের পড়াশোনা, চাকরি -বাকরির বিপক্ষে। তারা মেয়েদেরকে শোষণ করতেই পছন্দ করেন।এখানে আমি শাসন কথাটা বলবো না কারণ শাসন আর শোষণ দুইটা ভিন্ন শব্দ এবং এদের অর্থও ভিন্ন। শাসন শব্দটা তাদের ক্ষেত্রে যাবে যারা ভালোবাসতে জানে আর শোষণ কথাটা তাদের ক্ষেত্রে যাবে যারা সুযোগসন্ধানী পাবলিক। একজন মেয়ে পড়াশোনা করতে পারবে না, একজন মেয়ে চাকরি করতে পারবে না, একজন মেয়ে পাইলট হতে পারবে না! কোথায় লেখা আছে এসব কথা ? নেপালে যে প্লেনটা ক্রাশ করেছে সেই প্লেনে কোথাও লেখা ছিলো মেয়ে পাইলট ছিলো বলে সেই প্লেন ক্রাশ করেছে ? লেখা ছিলো কোথাও ?

একটা প্রবাদ বাক্য আছে - "যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা" এই প্রবাদ বাক্যটা ১০০% সঠিক। যাকে আপনি পছন্দ করবেন না তার সবকিছুতেই দোষ ধরা আপনার একটি স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়! ঘরে বাহিরে যা কিছু অঘটন হয়ে যাবে সব মেয়েদের দোষ। ১৫বছরের একটি মেয়ে ধর্ষিত হলেও মেয়েটির দোষ, ৫বছরের মেয়ে ধর্ষিত হলেও তার দোষ, ৫মাসের মেয়ে বাচ্চাটা ধর্ষিত হলেও তার দোষ! বর্তমানে কর্মে কিংবা বয়সে দোষ হয় না, দোষ হয় তার জেন্ডারে। দোষ যেই করুক সাথে বা আশপাশে মেয়ে থাকলেই তার দোষ। তার বয়স কত বা সে করলোটা কি সেটা জানার দরকার নেই। সে মেয়ে এটায় তার দোষ!

এই প্লেনে একটা মেয়ে পাইলট ছিলো বলেই সব দোষ তার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। বাকি সকল ত্রুটি এই মেয়ে পাইলটের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা যারা যারা মনে করছেন মেয়ে পাইলটের জন্য প্লেন ক্রাশ করেছে তাদের একটা প্রশ্ন করি ! আপনার নিজের কন্যা সন্তানটা যদি আজকে পাইলট হয়ে আকাশে পাখির মতো পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় আপনি তাকে উড়তে দিবেন তো ? আল্লাহ না করুক আপনার মেয়ের প্লেনটা যদি ক্রাশ করে আপনি তখন এই দোষটাই আপনার মেয়েকে দিবেন তো ? আচ্ছা আপনাদের ঘরে কি কন্যা সন্তান জন্ম নেয় ? আমাকে আরেকটা কথা বলেন তো, "বাবা কর্তৃক মেয়ে ধর্ষিত " এই নিউজগুলো আমরা তো আজকাল দেখছি, আপনারাই কি সে বাবা ? আপনাদের মতো মানুষগুলোই এমন পিতা হয়, নাকি ?

প্রতিটা পেশায় কে নারী, কে পুরুষ সেটা দেখা হয় না. দেখা হয় কে কতটা দক্ষ। আজকে যারা পৃথুলাকে নিয়ে কথা বলছেন , আমি নিশ্চিত করে বলে দিতে পারি তারা কেউ পৃথুলার একটা নখের যোগ্য হবে না। আপনি চাইলে রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, বাসের ড্রাইবার খুব সহজে হয়ে যেতে পারবেন কিন্তু একজন বৈমানিক চাইলেই হতে পারবেন না। আপনার অনেক টাকা আছে তাও হতে পারবেন না। আমি বৈমানিকের সার্টিফিকেট ১০০টা কিনে নিতে পারবেন কিন্তু ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম একটা প্লেন চালিয়ে যাওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন না।

বুকের মধ্যে সাহসের খুব বড় একটা আস্তানা লাগবে পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়ানোর জন্য, মেঘের সাথে তাল মিলিয়ে আকাশে ঘুরাঘুরি করার জন্য পাহাড় সমান সাহস লাগবে! আছে আপনার সেই সাহস ? মনে তো হয় না! যাদের বুকে এতো সাহস তারা ফেসবুকে বসে বসে সাহসী এক নারীকে নিয়ে এমন নোংরা আলোচনা করতে পারে না। সাহসী মানুষের রুচিবোধ এতো খারাপ কখনো হতে পারে না। সাহসী মানুষদের আত্মসম্মানবোধ খুব শক্তিশালী হয়, এতটা লেইম ব্রেন নিয়ে তারা চলাফেরা করে না। এরাই একমাত্র প্রফেশনাল মানুষ যাদের চাকরির প্রথমদিন থেকে মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয় যেকোনো সময় যেকোনো দিন পুড়ে মারা যাওয়া লাগতে পারে! যারা প্লেন চালায় আর যারা প্লেনে করে উড়ে বেড়ায় তাদের সবথেকে বেশি ভয় কাজ করে আগুনে পুড়ে মরার!

পৃথুলা ছিলো কো - পাইলট আর ক্যাপ্টেন ছিলেন আবিদ সুলতান, যার পাঁচ হাজার ঘন্টারও বেশি বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিমানের ত্রুটি ছিলো নাকি ০২ - ২০ এর দ্বিধায় এই দুর্ঘটনা ঘটলো সেটা এখনো পরিষ্কার না, কিন্তু কিছু মানুষরূপী জানোয়ার পৃথুলাকে নিয়ে একের পর এক নোংরা কথা, নোংরা ব্লেম দিয়েই যাচ্ছে। পৃথুলা নিজে মরার আগে ১০জন নেপালির প্রাণ রক্ষা করতে সাহায্য করেছেন , অথচ আমাদের দেশের মস্তিস্ক বিকৃত মানুষগুলো তার চরিত্রে একের পর এক দাগ দিয়েই যাচ্ছে। নেপাল যাকে "ডটার অফ বাংলাদেশ " উপাধি দিয়েছে, আমাদের দেশের মস্তিস্ক বিকৃত কীটগুলো তাকে উপহাস করছে এই বলে -

*এই সব জায়গায় মেয়ে লোক দিলে এই অবস্থা হবে।

*নর্থ সাউথে প্লেন চালানো শেখায়, জানতাম না।

*এই নারী-ফারী পাইলট কি ডুবালো নাকি সব কিছু।

*বাংলাদেশে মেয়ে পাইলট দিয়ে কি বিমান চালানো ঠিক।

*ঠিকই আছে এত ঘোরাঘুরির কি দরকার, খুব ভাল হইসে আরো মরা দরকার। টাকা উড়াইতে গেসে বাল গুলা।

*এই চুদিয়ার কারণে বিমানটি ইতিহাস হইসে, শালি প্লেন কোন্ট্রলের টাইমে সেক্স করতাসিল মেবি।

*অবিলম্বে নারী কোটার বিলুপ্তি চাই। ইউ.এস বাংলার পাইলট নারী কোটায় নিয়োগ প্রাপ্ত।

*এখানেও মহিলা পাইলট? এইটা ফাইজলামি নাহ? বাংলাদেশের এইটাই সব থেকে ভয়াবহ প্লেন ক্রাশ। আগেরটা হইসিল ১৯৭৯, সেটারও পাইলট সিলো মহিলা। মহিলাদের দিয়ে কার ড্রাইভ ভরসা করা যায়না, সেখানে এদের প্লেনের পাইলট বানায় কে?

পৃথুলা বোন আমাদের, তুমি গর্ব আমাদের। বেঁচে নিয়েছিলে এক চ্যালেন্জিং পেশা। মরার আগেও নিজের পেশাদারিত্ব ঠিক রেখেছিলে। নিজের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা না করে, যাত্রীদের জীবন বাঁচিয়েছো। নিজের পেশার প্রতি কতটা প্রেম থাকলে,, নিজের ভিতরে কতটা মানবতা থাকলে মানুষ এমন কাজ করতে পারে সেটা এই মস্তিস্ক বিকৃত কীটগুলো বুঝবে না। বোন তুমি মস্তিস্ক বিকৃত কীটগুলোর কথায় মনে কষ্ট নিও না। তুমি আমাদের কথা শোনো , আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ, তোমার এই উদারতার কাছে আমরা নত হলাম। তুমি আমাদের ক্ষমা করো আর আমাদের ভালোবাসা গ্রহণ করো। সাথে করে যাদের নিয়ে গেছো , তোমার সবাই মিলে ওপারে ভালো থাকো।

Leave a Comment