স্বপ্নের সমাধি ( প্রথম অংশ )

  • ফারজানা আক্তার 
  • ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৮

"এই শোন " কথাটা বলেই নিশি চুপ হয়ে গেলো। নিষাদ মুখ ফিরিয়ে নিশির দিকে তাকিয়ে রইলো। নিশির এই একটা অভ্যাস। মাঝেই মাঝেই এই শোন বলে চুপ হয়ে থাকে কিছুই বলে না। এই কথাটা বলেই উদাস হয়ে কোন এক দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে ঠিকমতো বুঝতে পারে না নিষাদ। কথায় আছে মেয়েদের নাকি স্বয়ং ঈশ্বরও বুঝতে পারে না। নিষাদ এই কথাটার সাথে একেবারে ২০০% একমত।  নিশিকে এতো চেষ্টা করেও একটুও বুঝতে পারে না নিষাদ। 

নিষাদ আর নিশি একই কলেজে পড়ে। তাদের বন্ধুত্ব খুব বেশি দিনের নয়, এই কলেজে এসেই তাদের পরিচয়। পরিচয়ের পরেই কেমন কেমন করে যেন তারা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। নিশি সবার সাথে তেমন একটা মিশে না। যাদের সাথে প্রথম কথা বলে ওর ভালো লাগে শুধু তাদের সাথেই মিশে। নিশিকে অনেক বেশি চুজি বালিকাও বলা যায়, আবার অনেক নেশা সাবধানী মেয়েও বলা যায়।  হয়তো অল্পতেই অনেকের মন বুঝতে পারে তাই বেশি দূর আগায় না। আবার হয়তো সবাইকে ওর পছন্দ হয় না তাই সবার সাথে তেমন একটা মিশে না। 

অনেকক্ষন ধরে নিশি কিছু বলছে না তাই নিষাদ নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করলো, "কিছু বলবি ?"  

নিশি : অনেক কিছু বলতে চাই। অনেক কথা বলতে চাই।  সময় কি হবে আপনার স্যার ?

নিশির এই একটা ন্যাকামি। এই কথা বলার অর্থ হলো ও এখন কিছুই বলবে না। চুপচাপ এখন নিজের মতো করে সময় কাটাবে।  মেয়েটার কি সমস্যা ! নিষাদের মাঝে মাঝে মনে হয় নিশির সাথে জ্বিন ভূত কিছু একটা রয়েছে।  তা না হলে এমন সুন্দর একটা সবসময় এমন পাগলামি কেন করে ? সেই প্রথম দিন যেদিন নিশি আর নিষাদের প্রথম কথা হয়েছিলো।  সেদিন দুইজনেরই কলেজের তৃতীয়দিন ছিলো। কলেজ শেষ করে যখন বাড়ি ফিরবে ঠিক তখনই নামলো ঝুম বৃষ্টি। সবাই কলেজের ভিতরেই যে যার মতো গল্প করছিলো। অনেকে রিকশা পেয়ে চলে গেছে , অনেকের বাড়ি কলেজের খুব কাছে তাই তারা ভিজেই বাড়ি চলে গেছে। আর যারা যেতে পারে নি তারা কলেজেই রয়ে গেছে। যেহেতু কলেজে তাদের খুব বেশি দিন হয় নি, তাই কারো বন্ধুত্বই তেমন জমে উঠে নি এখনো। এই বৃষ্টি তাদের সবার বন্ধুত্ব আজ এক করে দিচ্ছে। 

বেশিরভাগ মেয়েরাই আটকে গেছে বৃষ্টিতে। নিশি মেয়েদের আড্ডায় না যেয়ে কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলো। মেয়েদের আড্ডায় যে একেবারে নিশি যায় নি তেমন নয়, তবে তাদের কথাবার্তা নিশির ভালো লাগছিলো না। কলেজের কোন স্যার কেমন সুন্দর, কোন ম্যাম কি কালারের ড্রেস পরেছে, কেমন সাজ দিয়েছে, ক্লাসের কোন ছেলে কার সাথে আগে বাড়িয়ে কথা বলেছে এসব নিয়ে মেয়েরা গল্প করছে।  নিশির এসব ভালো লাগে না।  নিশির ভালো লাগে প্রকৃতি, নিশির ভালো লাগে বৃষ্টি, নিশির ভালো লাগে সবুজ ঘাসের উপর বৃষ্টির পানি, নিশির ভালো লাগে পাখির কিচিরমিচির, নিশির ভালো লাগে সাগরের বিশালতা, নিশির ভালো লাগে পাহাড়ের উচ্চতা। 

কলেজের বারান্দায় নিশি ধীর পায়ে পায়চারি করছে আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। হঠাৎ নিষাদ এসে নিশির পাশে দাঁড়ালো। নিশিই আগে নিষাদের সাথে কথা বললো।  নিশি জিজ্ঞেস করলো, "বৃষ্টি ভালো লাগে তোমার ?" চুপচাপ নিশির মুখে হঠাৎ কথা শুনে নিষাদ কিছুটা চমকে গেলো। নিজেকে সামলিয়ে নিষাদ বললো, "খুব বেশি ভালো লাগে না। তবে বৃষ্টি ভালো লাগে"। নিশি বললো, "আমার বৃষ্টি খুব ভালো লাগে। বৃষ্টি হলেই ভিজতে খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমার ঠান্ডার খুব সমস্যা তাই বৃষ্টিতে তেমন একটা ভিজা হয় না। "

নিষাদ খেয়াল করলো এই মেয়েটা এমনি খুব চুপচাপ কিন্তু একবার কথা বলা শুরু করলে কথা বলেই যায়। আর কথা বলে খুব আগ্রহ নিয়ে , কোনো ভনিতা বা ন্যাকামি ছাড়াই কথা বলে যায়। নিষাদ জিজ্ঞেস করলো, "তোমার বাসা কোথায় ? বাসায় যাবে না ?"

নিশি বললো, "আমার বাসা উত্তর পাড়ায়।  এতো বৃষ্টিতে বাসায় কিভাবে যাবো ? রিকশাও তো পাবো না এখন "

নিষাদ বললো, "উত্তর পাড়ায় কোথায় ?আমার বাসা উত্তর পাড়ার বড় মসজিদের কাছে। "

নিশি বললো, "তাই ? উত্তর পাড়ার বড় মসজিদের পিছনে যে মার্কেটটা আছে সেখানে আমার বাসা।  কোই তোমাকে তো আগে কখনো সেখানে দেখি নাই ?"

নিষাদ বললো, "আমার বাড়ি যাদবপুর। এখানে আমার খালার বাসা। আমার আব্বু আম্মু বাহিরে থাকে। সে অনেক কথা। অন্য একদিন সময় নিয়ে বলবো। চলো এখন বাসায় যাই।  তোমার বাসায় হয়তো সবাই চিন্তা করছে। " নিশির বাসায় আসলেই সবাই চিন্তা করছে। নিশির এই কথা মনেই ছিলো না। নিষাদের কথায় নিশির মনে পড়লো। নিষাদের এই দায়িত্ববোধটুকু নিশির খুব ভালো লাগলো। সেই প্রথমদিন থেকেই তাদের দুইজনের খুব ভালো ভাব হয়ে গেছে। 

এখন নিশি আর নিষাদ বসে আছে ছোট্ট একটি নদীর তীরে। নদীর তীরে বসে থেকেই নিশি হঠাৎ নিষাদকে বললো, "এই শোন " । নিশি বসা থেকে উঠে নদীর তীর দিয়ে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। নিষাদ বসে বসে নিশির এগিয়ে যাওয়া দেখছে। নিশির এমন ব্যবহারের সাথে নিষাদ পরিচিত। মেয়েটার মধ্যে সত্যি সত্যিই জ্বিন ভূত রয়েছে।  নিশি দূরে একটা জায়গায় যেয়ে থামলো তারপর নিষাদকে হাত ইশারাই ডাকলো। নিষাদ উঠে নিশির দিকে হাঁটা দিলো। নিশির কাছে যেয়ে নিষাদ নিশির একটা হাত শক্ত করে ধরলো। নিশির হাত শক্ত করে ধরে নিষাদ জিজ্ঞেস করলো, "তুই আমাকে কি বলতে চাস, বল ? মাঝে মাঝেই তুই আমাকে কিছু একটা বলতে যেয়ে চুপ করে থাকিস। কেন এমন করিস বল ?আজ তোর কথা শুনেই তোর হাত ছাড়বো আমি। " নিশি নিষাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, "যেকথা শোনার জন্য এতো শক্ত করে হাত ধরছিস সেকথা শোনার পর এমনিই হাত ছেড়ে দিবি। " এই কথা বলেই নিশি কিছুটা হাসার চেষ্টা করলো। 

নিষাদ নিশির হাত ধরেই বললো, "হাত ছাড়ি আর ধরি সেটা পরে দেখা যাবে আগে বল তুই আমাকে কি বলতে চাস ? আমি আজ তোর সে না বলা কথা শুনবো। আচ্ছা আমি জোর করছি না কিন্তু তোর কথা শুনতে চাচ্ছি। তোর সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই তুই আমাকে কিছু একটা বলতে চাস কিন্তু মাঝ পথেই কথা আটকে রাখিস। কেন ?" 

নিশি বলে, "আমি তোকে সব বলতে চাই কিন্তু ভয় পাই , খুব ভয় পাই। "

নিষাদ, "কিসের ভয় ?আমাকে তোর কিসের ভয় ?"

নিশি : তোকে আমার হারানোর ভয়! আমার এখন একটায় ভয় , সেটা হলি তুই। তোকে হারানোর ভয়ে আমি সব কথা বলতে যেয়েও বলতে পারি না , আবার না বলেও থাকতে পারছি না।  বারবার চেষ্টা করেও তোকে সব বলতে পারছি না। 

নিষাদ : নিশি নিশি ! দেখ এখন আমার মাথা পুরোটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি জানি তুই আমার খুব কাছের একজন বন্ধু। আমি মনেও করি তুই আমাকে এমনি কিছু ভাবিস। তাহলে আমাকে হারানোর ভয় তোর কিসের ? আর কি এমন কথা যে সে কথা শুনলেই আমি হারিয়ে যাবো। আমি হারিয়ে যাবো কেন ?আমি তোর আছি, তোরই থাকবো। নিষাদ উত্তেজিত হয়ে শেষের কথাটা বলে ফেলেছে। নিষাদের শেষের কথাটা শোনার সাথে সাথে নিশি নিষাদের চোখের দিয়ে তাকিয়ে আছে। নিষাদ নিশির হাতটা ছেড়ে দিয়ে নদীর দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নিশি ধীরে ধীরে নিষাদের বাম পাশে এসে দাঁড়ালো।   

নিশি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলো, "সত্যিটা জানার পর হারিয়ে যাবি, তখন আর আমার থাকবি নি। " 

চলবে...

Leave a Comment