মাতৃত্ব : পর্ব-৫

  • সুদীপ্তা ভট্টাচার্য্য রুমকি
  • মার্চ ২৮, ২০১৮

একটা বাসায় কাজ করতে একজন মহিলা এসেছে,সঙ্গে তার মেয়ে ও নাতিকে নিয়ে।যে বাসায় কাজ করতে এসেছে সেই বাসার মেয়েটিকে বললো, বাচ্চা নিয়ে কাজ করতে দিতে রাজি হয় না বেশিরভাগ বাসায়।অথচ তার মেয়ে তাকে সাহায্য না করলে বেশি কাজ করতে পারবেনা।কথাটা বলেই কাঁদতে শুরু করলো,বললো "মেয়ে আমার কাছেই থাকে।জামাইটা মানুষ না।সংসার করছে,বাচ্চার জন্ম দিছে অথচ একটা দায়িত্বও সে নিতে রাজি না।আমার কাছে পাঠাইয়া সব দায় শেষ করছে।নাতি আর মেয়ের না কোন খবর নিছে, না এক টাকা দিছে। নাতি চিনে না বাপ রে।তোমরা শিক্ষিত মানুষ,এই সমস্ত ছোটলোকি তো কল্পনাও করতে পারবা না মা।"মেয়েটির পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছিল।মনে হচ্ছিল চোখে ঝাপসা দেখছে।ও ভাবছিল এত ভয়াবহতা আসলেই ও কল্পনা করতে পারবে না।

যা নিজের জীবনে ভোগ করেছে তা কল্পনা করার কোন দরকার নেই তো ওর।লাইফ,কেরিয়ার সব বিসর্জন দিয়েও তো শেষ রক্ষা হয় নি।তাকেও তো ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে শুধু বাধ্য করাই হয়নি,এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সে ও তার সন্তানের প্রতি সকল প্রকার দায়বদ্ধতাও।ওর ছেলেও চিনে না বাবা কে।ওর হাজবেন্ড তো একটা দিকেও ঐ মেয়েটির হাজব্যান্ডের চেয়ে উন্নত নয়।অথচ কাজ করতে আসা মহিলাটির পরিবার শিক্ষা ,আর্থিক,সামাজিক অবস্থান সবদিক দিয়ে অনুন্নত। পক্ষান্তরে সে ও তার বাবা,মা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত,আর্থিক,সামাজিক অবস্থান সবদিক দিয়ে উন্নত।সে অবাক হয়ে ভাবছিল কি বিচিত্র এই সমাজ,কি সমতাপূর্ণ নারীর অবস্থান।গৃহকর্তার কন্যা আর গৃহভৃত্যের কন্যা এককাতারে দাড়িয়ে। কোথাও কোন পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না।দুজনের শ্বশুরবাড়ি দুই মেরুতে হলেও হাজব্যান্ড এবং শ্বশুর বাড়ির মুল্যবোধ হুবুহু এক ছিল।দুজনেই পারিবারিক নির্যাতনের শিকার।দুজনেই লড়ছে বাচ্চার জন্য। 

দুজনেই বাধ্য হয়েছে এককভাবে বাচ্চার দায়িত্ব পালনে।যারা বলেন শিক্ষা,অর্থনৈতিক সক্ষমতা নারীর অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে, আমার তাদের কাছে প্রশ্ন-আমাদের হিপোক্রেট সমাজে আসলেই তা কতটুকু সম্ভব! রুমানা মঞ্জুর তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।পারিবারিকভাবে হতদরিদ্র তো ছিলেনই না বরং নিজেও যথেষ্ট সাবলম্বীই ছিলেন,সামাজিক অবস্থানও দৃঢ় ছিল নিজের শুধু না বাবা,মায়েরও।তিনি কি পারতেন না এই বিবাহিত সম্পর্কটা ত্যাগ করতে?উনার কি ফিরে যাওয়ার জায়গা ছিল না?তিনি কেন সেই সাহসটা করতে পারলেন না? তিনি শেষ পর্যন্ত সংসারটা ভাঙ্গতে চান নি কেন?একক ভাবে বাচ্চার দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতা কি তার ছিল না?সেই উত্তর- আমি,আপনি,আমরা সবাই জানি,আর তা হলো সন্তান।তিনি নিজেও বলেছিলেন তার কন্যার জন্য তিনি ও পথে হাটতে চান নি।

আসলেই আমাদের সমাজ কি নিস্তার দেয় মা ও তার ছোট্ট শিশুকে?অবুঝ শিশুর সামনেই বিকৃত রুচির প্রকাশ ঘটানো হয় অবলীলায়,ভিকটিম এর কাছেই জানতে চাওয়া হয় আপনার অনুভুতি এই ঘটনায়!This is our society!!ভদ্র হতে এখনও অনেক বাকী। সমাজ প্রতিনিয়ত ছোট্ট শিশুকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে দ্বিধাবোধ করবে না।তা দেখার মত ভয়ঙ্কর কাজের দায়িত্ব নিয়ে,সন্তান কে এই বিভীষিকা এর ভিতর দিয়ে নিতে কোন মা ই চায়না।তখন সহ্য করা ছাড়া তার কাছে কোন পথটা খোলা থাকে?চরম আত্মপ্রত্যয়ী একজন মেয়েও ঠিক এই জায়গায় কেমন জানি মিইয়ে যায়। যেকোন উচ্চশিক্ষিত, মুক্তমনা,নিজের পায়ে দাড়ানোর ক্ষমতাসম্পন্ন মেয়ের জীবনে আসলে অসাধারন ব্যক্তিত্বের একজন আদর্শ বাবা থাকে। বাবা শব্দটির সাথে তার এত নির্ভরতা ও ভালবাসা জড়িয়ে থাকে যে এর বাইরেও যে জন্মদাতার কোন রুপ থাকতে পারে তা বুঝতে পারলেও বিশ্বাস করতে পারেনা।সে মনে করে আজ না হয় কাল হয়তো মানুষটি ভুল বুঝতে পারবে,একজন আদর্শ বাবায় পরিণত হবে।

নিজের মনকে জোরজবরদস্তিতে সে ক্রমাগত তাই বোঝাতে থাকে।আর এখানেই সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলে তারা কারন তার নিজের বাবা আদর্শ বাবা শুধু ছিলনা তার মায়ের আদর্শ জীবনসঙ্গীও ছিল। একজন পিতা তখনই সন্তানের চোখে আদর্শ হয় যখন তার মা কে যথাযথ সম্মান করার ক্ষমতা সেই পিতার থাকে।মা কে হেনস্থাকারী,নির্যাতনকারী কোনদিনও সন্তানের চোখে আদর্শ হতে পারে না।বাবা নামের যোগ্য না যে ব্যাক্তি সেও সন্তান নামক সম্পত্তির সর্বময় কর্তা নিজেকে দাবি করে সন্তানের আয়া স্বরুপ একটা মায়ের অবদান কে মুল্যায়ন করতে লজ্জা যেমন নিজে অনুভব করেনা তেমন সমাজের কোন ক্ষেত্র থেকে তাকে তা করানোও হয় না।

 

Leave a Comment