তৃণমূল শ্রমিক তারা

  • বৈতরণী হক
  • এপ্রিল ২৯, ২০১৮

দশ বছর আগে বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকাতে একটু খুঁজলেই গৃহকর্মীর সন্ধান মিলতো কিন্তু এখন দেশে গেলে, বাসায় বা আত্মীয় স্বজনদের ফোন দিলে একট কমন অসুবিধার কথা শুনি তা হলো বাসায় কোন কাজের মানুষ নাই। আমরা যারা বাইরে থাকি তাদের নিজেদের ঘরের কাজ নিজেদের করতে হয় কারণ এখানে প্রায় সবার বাসায় আছে কমবেশি সুযোগ সুবিধা।  বাংলাদেশে এখানকার মত সুবিধা না থাকায় সাহায্যকারী ছাড়া আসলেই  ঘরের কাজ সামলানো বেশ কঠিন। 

বিশ্বায়ণের জোয়ারে আমাদের দেশের গতি মন্থর হলেও কিন্তু আমরা পিছিয়ে নেই। যদিও আমাদের গতিটা কচ্ছপ গতি তাও তো স্থবির নই আমরা। তৃণমূল পর্যায় থেকে সেই আলোচনা শুরু করি। ঢাকা শহরে আগে বাসাবাড়িতে জামালপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, পাবনা এইসকল জায়গা থেকে বেশি মহিলারা আসতো কাজের সন্ধানে। আমাদের বাসাতেও এসব জায়গার মহিলারা বিভিন্ন সময়ে কাজ করতো বলে মনে আছে। এখনো এসব জায়গা সহ সারা দেশ থেকে ঢাকায় মহিলারা  আসে কাজের সন্ধানে তবে বেশি কাজ করে ফ্যাক্টরী গুলোতে। গার্মেন্টসে কাজ করার পাশাপাশি জুতা, প্লাস্টিক, খাদ্য সামগ্রী সহ নানা জিনিসের কারখানায় তারা কাজ করে। যারা কারখানায় কাজ করে না তারা বাসা -বাড়িতে ছুটা কাজ করে, আজকাল স্হায়ী মানে বান্ধা মানুষ পাওয়া যায় না বললেই চলে আর পাওয়া গেলেও সেক্ষেত্রে তাদের পিছনে গুনতে হয় অনেক টাকা। মধ্যবিত্ত শ্রেনীর জন্য তা কখনো হয়ে উঠে বাজেটের অতিরিক্ত খরচ। জীবন ধারণের আনুষংগিক দ্রব্যাদির দামের উর্ধ্বগতি প্রভাব ফেলছে সবার উপরেই আর সাথে বাড়ছে মানুষের জীবনযাপনের মান, স্বাধীনচেতা মনোভাব।

শুধু যে ঢাকা কেন্দ্রিক এই নিম্নবিত্ত শ্রেনীর অর্থনীতি চলছে তা কিন্তু নয়।  যে সকল জেলাগুলোতে কিছু কিছু শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে সেখানে স্থানীয় গরীব নারীদের কর্মসংস্হানের ব্যবস্হা হচ্ছে ফলশ্রুতিতে কমে যাচ্ছ তাদের ঢাকামুখী হবার প্রবণতা। বিপুল সংখ্যক নারী আর পুরুষ উত্তরবংগ থেকে ভিড় করেছে কক্সবাজারে কাজের আশায়। এই অভ্যন্তরীন অভিবাসন নিঃসন্দেহে তাদের অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান করছে যা তাদের জীবন যাপণে সামান্যতম উন্নয়নের জন্য কিছুটা হলেও সাহায্য করছে। 

নব্বইয়ের দশক ার তার কিছুটা পর পর্যন্ত সৌন্দর্য্য, সমসাময়িক ফ্যাশন সীমাবদ্ধ ছিলো শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত শ্রেনীর নারীদের মাঝে। এখন তা ছড়িয়ে গিয়েছে নিম্নবিত্ত শ্রেনীর নারীদের কাছেও। খেয়াল করলে দেখা যাবে ভ্রুপ্লাক, হেয়ার কাট ছাড়া আজকাল কোন মেয়ে পাওয়া যায় না ঢাকাতে যদি না সে পর্দা করে এমনকি এটা মফস্বল এবং গ্রামের ক্ষেত্রে ও প্রযোজ্য। ঘরের সাহায্যকারী মেয়ে থেকে শুরু করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ম্যাডাম সবাই নিজেকে সুন্দর রাখতে চায়। মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত নারীদের পাশাপাশি নিম্নবিত্ত নারীদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক শিল্প কারখানা। সস্তা দামের কসমেটিকস, ড্রেস, ইমিটেশন জুয়েলারি কি নাই তাদের সামর্থ্যের নাগালে। যেই ভ্রুপ্লাক দামী শীতাতাপ নিয়ন্ত্রির পার্লারে ৫০০ টাকা নেয় সেটাই তারা করে ছোট একটা ঘরে বসে ৮০ কি ১০০ টাকা দিয়ে তাও  তারা নিজেকে সুন্দর দেখতে চায়। এইসব নারীদের নিজের প্রতি ভালোবাসাটা ার আত্মবিশ্বাস যে জন্মেছে সেটও কিন্তু একটা বড় প্রাপ্তি। 

পার্লারের কথা যখন উঠলো তখন প্রশংসা করতে হয় বাংলাদেশের গারো উপজাতির মেয়েদের যারা মান্দি নামেও পরিচিত। ময়মনসিংহ, টাংগাইল জেলা আর পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে তাদের বেশি বসবাস। গারো মেয়েরা পার্লারে সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষতার জন্য সারা বাংলাদেশে সুপরিচিত। বাংলাদেশের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে পার্লারের কাজের জন্য তারা যায়নি । মারমা, রাখাইন, তংচইংগা আর সমতলের বাংগালি মেয়েরা এই পেশায় নিয়োজিত থাকলেও এই ইন্ডাস্ট্রিতে  এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মেয়েদের কাজের কদর বেশি। ক্ষুদ্র  নৃগোষ্ঠীর এমন সাফল্য সত্যি প্রশংসার যোগ্য। যদিও তাদের কাজ আর জীবন নিয়ে গবেষণা জোরালো ভাবে হয়না। তাদের কাজের পরিবেশ, কর্মক্ষেত্রে মজুরি, মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে  সুনির্দিষ্ট আইন আছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। অথচ  ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহ  প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের নারীদের সেবা করে যাচ্ছে, তারা হয়ে গিয়েছে আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের অংশ। 

 বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত শ্রেনীর নারীরা দিনে দিনে নিজেদের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করছে। ামাদের দেশের তৃণমূল শ্রেনীর নারীদের ার্থিক স্বাধীনতা আর াত্ম বিশ্বাস গড়ে উঠছে। এই গতিটা ধরে রাখতে পারলে আমরা একসময় ার্থ-সামাজিক ভাবে অনেক এগিয়ে যাবো। তবে তার জন্য প্রয়োজন নারী অধিকার সনদগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন, তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যরোধ, সামাজিক এবং পারিবারিক নিরাপত্তা প্রদান। খেটে খাওয়া নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পূর্ণ সদিচ্ছা থাকলেও এসকল বিষয়ে সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের অবদমিত হয়ে থাকতে হয়। কাদা ছুঁড়াছুঁড়ির রাজনীতিতে এইসব নারীদের নিয়ে সব ালোচনাই গৌণ। দেশের নারী অধিকার সনদের সঠিক আর বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ণের মাধ্যমে গড়বে তৃণমূল নারী শ্রমিক শ্রেনীর মনোবল আর কর্মদক্ষতা। মনে রাখতে হবে এরাই দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী। এদের সমষ্টিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমেই আসতে পারে পরিবার এবং সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন।
 

Leave a Comment