শিশুর কানের সংক্রমণ ও চিকিৎসা  

  • তন্ময় আলমগীর
  • অক্টোবর ২৬, ২০১৮

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২৩ শতাংশ শিশু প্রথম জন্মদিন হওয়ার আগে অন্তত একবার কানের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে, এবং অর্ধেকেরও বেশীর ক্ষেত্রে ৩ বছরে একবার কানের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়। কানের সংক্রমণের আগে সাধারণত ঠান্ডা অথবা সাইনাস সংক্রমণ দেখা দেয়।

যেভাবে বুঝবেন শিশুর কানে সংক্রমণ হয়েছে!

ডায়রিয়া বা বমিঃ  কানের সংক্রমণের জন্য যে জীবাণু দায়ী তা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এর ফলে বাচ্চার ডায়রিয়া বা বমি হতে পারে।

রুচি কমে যাওয়া:  আপনার শিশু কানের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে থাকলে, সে স্তনে বা বোতল ফিডার থেকে কয়েক চুমুক দুধ নেওয়ার পর মুখ সরিয়ে নেবে। কানের সংক্রমণগুলো গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনালের কাজে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তারা শিশুর খাদ্য গেলা এবং চাবানোর কাজকে কষ্টদায়ক করে তোলে।

হলুদ বা সাদাটে তরল কান থেকে গড়িয়ে পড়া:  সব শিশুদের ক্ষেত্রে এমন ঘটে তা না, কিন্তু এটি নিশ্চিত ভাবে সংক্রমণের লক্ষণ। এটি আরো নির্দেশ করে যে, কানের পর্দায় ছিদ্র হয়েছে ।

ঘুমের অসুবিধা : শুইয়ে রাখলে কানের সংক্রমণ আরো কষ্টকর হয়ে উঠে। যার কারণে শিশুর ঘুমের সমস্যা হতে পারে। এছাড়া শিশুর সংক্রামিত  কান থেকে আসতে পারে বাজে গন্ধ।

শিশুর কান সংক্রামিত হওয়ার কারণ: সাধারণত কোন তরল যখন কানে প্রবেশ করে তখন তা ইউস্টাশিয়ান টিউবের  মাধ্যমে দ্রুত বেরিয়ে যায়। যা মধ্যকর্ণকে নাক এবং গলার পেছন দিকে সংযুক্ত করে। অবশ্য একটি ইউস্টাশিয়ান টিউব যদি বন্ধ থাকে- যা প্রায়শই ঘটে ঠান্ডা লাগলে, সাইনাস সংক্রমণে, এমন কি এর্লাজীতে – তখন তরল মধ্যম কর্ণে আটকা পড়ে। একটি তরল ভর্তি মধ্যম কর্ণ হল জীবাণুর বংশবৃদ্ধির উপযুক্ত জায়গা। সংক্রমণ যখন খারাপ হতে থাকে, কানের পর্দার ভেতরে ও বাইরে প্রদাহ আরো খারাপ হতে থাকে, পরিস্থিতিকে আরো যন্ত্রণাদায়ক করে তোলে। পেসিফায়ার বা চুষনির ব্যবহার, নবজাতক ও শিশুদের মধ্যম কর্ণের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কানের সংক্রমণের ঘটনা সে সব শিশুদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ কম যারা পেসিফাইয়ার ব্যবহার করে না।

শিশুর কানের সংক্রমণের চিকিৎসা : অ্যান্টিবায়োটিক ছিল কানের সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম ব্যবস্থা। কিন্তু এখন চিকিৎসকরা অনেক চিন্তাভাবনা করে ওষুধ দেন কারণ অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক নেয়ার ফলে সন্তানের এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণের প্রবণতা হতে পারে।
যদি আপনার শিশুর বয়স ৬ মাস বয়সী হয়, আপনার চিকিৎসক শিশুর সংক্রমণের ব্যথা দুর করার জন্য বাচ্চাদের ‘অ্যাসিটামিনোফেন বা আইবুপ্রোফেন” দেয়ার কথা বলতে পারেন।( কখনো আপনার শিশুকে এসপিরিন খাওয়াবেন না, কারণ তা রাইয়েস সিন্ড্রোমের সম্ভাবনা জাগায়। এটি  একটি দূর্লভ কিন্তু ক্ষতিকর রোগ।)

যদি কয়েক দিনের মধ্য অবস্থার উন্নতি না হয় তবে ডাক্তার দেখাতে দেরী করা উচিত নয়। যদি আপনার শিশুর অবস্থা ৪৮ বা ৭২ ঘন্টার মধ্য ভাল না হয়, চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করার জন্য বলতে পারেন এবং আবার পরীক্ষার জন্য আসতে বলতে পারেন।  চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দিলে অবশ্যই ঔষধের কোর্স সম্পূর্ণ শেষ করতে হবে। ওষুধের কোর্স সমাপ্ত হওয়ার আগেই শিশুটি সুস্থবোধ করতে পারে। তবে এতে ওষুধ বন্ধ না করে কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তা না হলে ইনফেকশন সৃষ্টিকারী জীবাণু ওষুধটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। তখন শিশুটির কানে ইনফেকশন হওয়ার অশঙ্কাও বেড়ে যায়।  আপনি  কয়েক সপ্তাহ পর কানের আরেকটি পরীক্ষা করাতে পারেন, তাহলে চিকিৎকদের নির্ধারন করতে সুবিধা হবে ঔষধ ভালভাবে কাজ করছে কিনা।
 
কিভাবে ভবিষ্যতে কানের সংক্রমণ প্রতিরোধ করবেন?

জীবাণু ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য  টয়লেটের পর, ডায়াপর পরিবর্তনের পর, এবং খাওয়ার আগে বা খাওয়া তৈরী করার আগে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।

আপনার শিশুর টীকা হালনাগাদ রাখাঃ  ‘নিউমোকক্কাল কনজুগেট ভ্যাকসিন (পিসিভি)’ দারুনভাবে শিশুদের কানের সংক্রমণ সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। গবেষণায় দেখা গেছে ইমিউনাইজেশন জন্য যখন থেকে ‘নিউমোকক্কাল কনজুগেট ভ্যাকসিন (পিসিভি)’ দেয়া হচ্ছে, ৩ বছর বয়েসী শিশু যাদের অন্তত পক্ষে একবার কানের সংক্রমণ হয়েছে  তাদের সংখ্যা ২০ শতাংশে কমে এসেছে। আপনার শিশুর যদি বারবার কানের সংক্রমণে আক্রান্ত হয় বিশেষত ফ্লু হওয়ার পর, সেক্ষেত্রে আপনার শিশুর ফ্লু ভ্যাকসিন নেয়া উচিত কিনা তার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন । (শুধুমাত্র ৬ মাস বয়েসী শিশু ফ্লুর টীকা নিতে পারে।)

শিশুকে ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ পান করানো : ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এবং ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব শিশুকে তাদের জীবনের প্রথম ছয়মাস মায়ের বুকের দুধ পান করানো হয়েছে, তারা কম কানের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়। যাদের টিনের দুধ দেয়া হয়, তাদের ৭০ শতাংশ বাচ্চার ক্ষেত্রে কানের সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ওটোল্যারিঙ্গোলজিস্ট রবার্ট রুবেন এর মতে মায়ের বুকের দুধের সাথে সাথে ইমিউন-বিল্ডিং অ্যান্টিবডি শিশুর শরীরে প্রবেশ করে থাকে। তবে অ্যান্টিবডি গুলো ছয়মাস পরে হ্রাস পেতে থাকে।

টোবাকোর ধোঁয়া থেকে আপনার শিশুকে নিরাপদে রাখুনঃ  গবেষকার এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন, যেসব পিতামাতা নিয়মিত ধূমপান করেন তাদের শিশুদের কানের সংক্রমণ হয় এবং শ্রবণে সমস্যা হয়। শিশু যখন ধূমাপয়ীদের সাথে থাকে তাদের ৩৭ শতাংশের মধ্যম কর্ণের সংক্রমণ এবং শ্রবণে সমস্যা হয়, এবং ধূমপায়ী মায়েরা যারা বাসায় ধুমপান করেন তাদের ৬২ শতাংশ শিশু উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। যেসব মায়েরা বাসায় ধূমপান করেন তাদের বাচ্চাদের ৮৬ শতাংশর ক্ষেত্রে মধ্যম কানের সমস্যার জন্য অপারেশন করাতে হয়, যাদের বাসায় কোন ধূমপায়ী নেই তাদের তুলনায়।

Leave a Comment