মেয়েদের ওভার অ্যাক্টিভ ব্লাডার সমস্যা নিয়ে কিছু কথা 

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
  • নভেম্বর ৫, ২০১৭

অরিনরা ভার্সিটি থেকে পিকনিকে যাচ্ছে। সকাল ৯টায় গাড়ি ছাড়ার কথা এখন ১০টা বেজে গেছে , গাড়ি ছাড়ার কোনো নাম নেই। অরিন যেয়ে তাদের টিচারকে জিজ্ঞেস করলো কখন বাস ছাড়বে। স্যার বললো ১০মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে দিবে।  অরিন খুব এক্সসাইটেড কারণ বড় হবার স্বাধীনতা এই প্রথম সে পাচ্ছে। আগে কখনো একা একা বন্ধুদের সাথে কোথাও যাবার সুযোগ তার হয় নি। 

স্যার ঠিক কথায় বলেছিলেন। ঠিক ১০মিনিট পরেই বাস ছাড়লো। অরিনের এক্সসাইটেড ১০০পার গেছে মনে হচ্ছে। খুব খুব খুশি সে। বন্ধুদের সাথে সেও চিৎকার করে গান গাইতে শুরু করলো।  হটাৎ করেই তলপেটে অস্বস্তি অনুভব করলো অরিন। বাস ছাড়ার আগেই তো ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলো সে। তলপেটের চাপ বেড়েই চলছিলো, মুহূর্তেই হারিয়ে গেলো সব আনন্দ। 

কোনো উপায় না দেখে বন্ধুদের বললো কোনো পেট্রল পাম্প দেখে গাড়ি তাড়াতাড়ি থামাতে। ভাগ্য ভালো সামনেই একটা পেট্রল পাম্প ছিলো। অরিন প্রস্রাবের যে সমস্যায় ভুগছেন, তা অত্যন্ত বিরক্তিকর এবং একই সঙ্গে বিব্রতকর একটি সমস্যা। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলা হয় ওভার অ্যাক্টিভ ব্লাডার বা অতি ক্রিয়াশীল মূত্রাশয়।

এ সমস্যায় রোগীকে দিনের বেলায় ঘন ঘন প্রস্রাব করতে হয়, হঠাৎ প্রবল বেগ পায়, দ্রুত টয়লেটে যেতে হয় এবং মূত্র ত্যাগ বিলম্বিত করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। মাঝে মাঝে টয়লেটে যেতে যেতে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কাপড়ে প্রস্রাব হয়ে যায়। রাতে একাধিকবার ঘুম ভেঙে প্রস্রাব করতে উঠতে হয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি (ক্রনিক) সমস্যা, যা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। রোগের তীব্রতা কিছুদিন বেড়ে যায়, আবার কিছুদিন একটু সহনীয় পর্যায়ে আসে। আমাদের দেশে কত শতাংশ মহিলা এ রোগে ভুগছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, এশীয় মহিলারা স্থান বা দেশভেদে ১৬ থেকে ৫৩ শতাংশ ওভার অ্যাক্টিভ ব্লাডারের সমস্যায় ভুগছেন। আমেরিকায় ২০ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার এ সমস্যা রয়েছে।

স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় মূত্রাশয়ে (কিডনি) থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে আসা মূত্র জমা হতে থাকে। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমা হলে আমাদের প্রস্রাবের বেগ হয় এবং যথাযথ সুযোগ ও স্থান না পেলে বেশ কিছু সময় পর্যন্ত প্রস্রাব ধরে রাখা যায়। কিন্তু অতি ক্রিয়াশীল মূত্রাশয় রোগে মূত্রথলিতে সামান্য প্রস্রাব জমলেই মূত্র ত্যাগের প্রবল তাড়া অনুভূত হয়, যা দমন করা কষ্টকর। ফলে রোগী এই তাড়া থেকে মুক্তি পেতে ঘন ঘন প্রস্রাব করে। এ সমস্যা রোগীর জীবনে অত্যন্ত নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। প্রথম প্রথম বাইরে বের হলেই কাছাকাছি টয়লেট খুঁজে রাখে। ধীরে ধীরে বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে বাইরে বেরোনো কমে যায়। কর্মজীবী মহিলাদের বারবার টয়লেটে যাওয়ার ফলে অফিসের স্বাভাবিক কাজে বিঘ্ন ঘটে এবং সমস্যা আরও প্রকট হলে কর্মদক্ষতা কমে আসে, এমনকি কর্মস্থলে অনুপস্থিতি বেড়ে যায়।

অতি ক্রিয়াশীল মূত্রাশয়ের বিষয়ে আমাদের রয়েছে ভ্রান্ত ধারণা ও সংস্কার। অনেকে মনে করেন, বাচ্চা প্রসবের কারণে বা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি স্বাভাবিক দুর্বলতা। আবার অনেকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও মনে করেন, এ রোগের ভালো চিকিৎসা নেই বা লজ্জার কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না। কেউ কেউ নিজের অভ্যাস ও জীবনাচরণে পরিবর্তন এনে এ সমস্যার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। যেমন—কেউ পানি খাওয়া কমিয়ে দেন, কেউ বা আবার পানি বেশি খেলে ভালোভাবে প্রস্রাব হয়ে যাবে ভেবে অতিরিক্ত পানি পান করেন এবং তাড়া এড়ানোর জন্য বেগ হওয়ার আগেই মূত্র ত্যাগের অভ্যাস করেন। অনেকে কোথাও যাওয়ার আগে সেই স্থানে টয়লেট আছে কি না, জেনে নেন, এমনকি যেসব জায়গায় টয়লেট নেই, এমন স্থানে যাওয়া বন্ধ করে দেন। আর যাঁদের বেগ এলেই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কাপড়ে প্রস্রাব হয়ে যায়, তাঁরা প্যাড বা কাপড় ব্যবহারের অভ্যাস করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ রোগী চিকিৎসা সহায়তা নেওয়ার আগে অন্তত দুই বছর অতি ক্রিয়াশীল মূত্রাশয়ের উপসর্গে ভোগেন।

চিকিৎসা :

চিকিৎসার শুরুতেই যথাযথ রোগ মূল্যায়নের জন্য রোগীকে তিন থেকে পাঁচ দিনের ব্লাডার ডায়েরি বা পানীয় গ্রহণ এবং মূত্র নিঃসরণের তালিকা তৈরি করতে দেওয়া হয়। এ রোগের চিকিৎসায় এই চার্ট বা তালিকা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। রোগী আগে থেকে যেসব ওষুধ খান, তাও ভালোভাবে নিরীক্ষা করতে হয়। রোগের ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষার পর এবং ব্লাডার ডায়েরি বিশ্লেষণ করে ও প্রস্রাব পরীক্ষা করেই চিকিৎসক এ রোগের অন্য কোনো কারণ থাকলে তা চিহ্নিত করতে পারেন। প্রয়োজনে আলট্রাসনোগ্রাফির সহায়তা নেওয়া হয়।

অন্য কোনো কারণ না পাওয়া গেলে ওভার অ্যাক্টিভ ব্লাডারের চিকিৎসা শুরু করা হয়। প্রথমত, রোগীর জীবনাচরণ ও অভ্যাসে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে। যেমন—ধূমপান পরিহার করা, অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলা, কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখা ইত্যাদি। প্রস্রাবের পরিমাণ ও আবহাওয়ার উষ্ণতার ওপর নির্ভর করে পরিমিত পানি পান (কখনোই অতিরিক্ত নয়), যেসব পানীয়তে প্রস্রাবের মাত্রা বেড়ে যায়, যেমন—চা, কফি, কিছু ফলের রস, বিভিন্ন কোমল পানীয় ইত্যাদি পান করা কমিয়ে দিতে হবে।
 
বহুমূত্র রোগ থাকলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এর সঙ্গে রোগীকে তাঁর মূত্রদ্বার, যোনিপথ ও মলদ্বারের চারপাশের মাংশপেশিগুলোকে (পেরিনিয়াল মাংশপেশি) নিয়মিত বিরতিতে সংকোচন ও প্রসারণের ব্যায়াম শিখতে হবে। এ ছাড়া মূত্রাশয়ের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মূত্রাশয়ের পুনঃপ্রশিক্ষণের জন্য রোগীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ প্রশিক্ষণে রোগী ধীরে ধীরে প্রস্রাব বেশিক্ষণ ধরে রাখা এবং মূত্র ত্যাগের মধ্যবর্তী সময় বাড়ানোর অভ্যাস করেন।

ছয় সপ্তাহের মধ্যে উপসর্গের যথেষ্ট উন্নতি না হলে উপরিউক্ত চিকিৎসা বা থেরাপির সঙ্গে ওষুধ ব্যবহার শুরু করা হয়। এ রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করা হয়, আর অতিসম্প্রতি কিছু ভালো ওষুধ বাজারে এসেছে। যে ওষুধ বা ব্যবস্থাপত্রই দেওয়া হোক না কেন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তা দীর্ঘদিন খেতে হবে। ওভার অ্যাক্টিভ ব্লাডারে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয়, সেসব ওষুধের সবগুলোরই কমবেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এর মধ্যে মুখ ও গলা শুকিয়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, চোখে ঝাপসা দেখা অন্যতম।

নতুন ওষুধগুলোর এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিছুটা কম হলেও একেবারে মুক্ত নয়। আর বড় কথা হলো, ওষুধ খাওয়া শুরু করার পর থেকে উপসর্গের উন্নতি দেখা দিতে বেশ সময় লাগে, ফলে অনেক সময়ই রোগীরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। তাই এ রোগের চিকিৎসায় প্রয়োজন মনোবল ও ধৈর্য। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনাচরণ ও অভ্যাসে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনুন এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সঠিক নিয়মে ওষুধ সেবন করুন।

তথ্য এবং ছবি : গুগল
 

Leave a Comment