কেমন হবে গর্ভকালীন মায়ের খাবার ?

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
  • নভেম্বর ৮, ২০১৭

মায়ের কাছ থেকেই তার গর্ভের সন্তান পুষ্টি পায়। অনাগত সন্তান আর মায়ের সুস্থতা অনেক ক্ষেত্রে গর্ভকালীন খাবারের ওপর নির্ভর করে। অনেক মা দ্বিধায় ভোগেন কী খাওয়া উচিত, কী উচিত নয়। অনেকে উদ্বিগ্ন থাকেন বাড়তি ওজন নিয়েও।
 
একজন সুস্থ মা-ই পারেন সুস্থ-সবল শিশুর জন্ম নিশ্চিত করতে। এ কারণে গর্ভবতী মায়েদের শরীরের যত্ন নিতে ডাক্তার ও পুষ্টিবিদরা সব সময় পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাঁর খাবার যেমন পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যপ্রদ হবে, তেমনি তাঁকে নিজের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। যে খাবার খাবেন তাও যথাযথ পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত হতে হবে, যাতে কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে তিনি আক্রান্ত না হন।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্য ঘাটতিতে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের সন্তান হয় ওজনে কম ও লম্বায় ছোট। বহু ক্ষেত্রে গর্ভেই সন্তান মরে যায়, জন্মের কিছু সময় পর সন্তান মৃত্যুমুখে পতিত হয়, গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে, সময় হওয়ার আগেই সন্তানের জন্ম হয়ে যায়, ফলে শিশু থাকে অপরিণত।

বাংলাদেশে গর্ভবতী মায়েদের খাবার নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তি যেমন আছে, তেমনি অজ্ঞতার ফলেও অনেকের পক্ষে উপযুক্ত খাবার খাওয়া সম্ভব হয় না। বহু মানুষের ধারণা, মা যদি বেশি খাবার খায় তাহলে গর্ভের সন্তান আকারে বড় হবে। তখন স্বাভাবিক ডেলিভারি সম্ভব হবে না। তাই গর্ভবতী মাকে কম খেতে দেওয়া হয়। যা মা ও শিশুর জন্য ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে।

আবার অনেকের মতে, একজন গর্ভবতী মাকে দুজনের খাবার খাওয়া উচিত। এটাও ঠিক নয়। কারণ অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের সঙ্গে মুটিয়ে যাওয়ার সম্পর্ক আছে। অতিরিক্ত ওজনের মায়েদের ক্ষেত্রে মৃত সন্তান অথবা ছোট শিশুর জন্মদানের ঘটনা বেশি। তবে খাবার যেমনই হোক না কেন, সেটা হতে হবে পুষ্টিকর। এ জন্য প্রতিদিনের খাবারে খাদ্যের সব কয়টি উপাদানের উপস্থিতি থাকতে হবে।

প্রোটিন বা আমিষ :

প্রোটিন বা আমিষজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে দৈনিক ৯০-১০০ গ্রাম। অর্থাৎ অন্য ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি। এই পরিমাণ প্রোটিন পাওয়া যায় মাঝারি আকারে তিন টুকরা মাংস থেকে। প্রোটিন আসতে পারে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, বাদাম, শিমের বিচি থেকে। প্রোটিন গর্ভস্থ শিশুর কোষ ও মস্তিষ্কের সঠিক গঠনে সহায়তা করে। মায়ের স্তনকোষ বাড়ায়। শ্রোণিচক্রকে সন্তান জন্মদানে উপযোগী করে।

ফ্যাট বা চর্বি :

চর্বিজাতীয় খাবার শক্তির ভালো উৎস। এগুলো চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনকে কাজে লাগায়। আর এসব ভিটামিন স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক গঠন নিশ্চিত করে। চর্বি পাওয়া যায় ঘি, মাখন, তেল, মাংসের চর্বি থেকে।

কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা :

শর্করাজাতীয় খাবারও শরীরে শক্তি জোগায়। শর্করা পাওয়া যায় ভাত, রুটি, চিঁড়া, মুড়ি, খই, আলু, চিনি, মিষ্টি ও গুড় থেকে। অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট এড়িয়ে চলতে হবে।

ক্যালসিয়াম :

নবজাত শিশুর হাড় গঠনের জন্য গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে খাবারে ক্যালসিয়াম বেশি আছে এমন খাদ্য বাড়াতে হবে। দুধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস। তবে দুধ বেশি খেতে না পারলে ডাল, ছোট মাছ ইত্যাদি খেয়েও ক্যালসিয়ামের চাহিদা মেটানো যায়। গর্ভকালীন দৈনিক ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রয়োজন।

ভিটামিন :

ভিটামিন ‘এ’ ও ভিটামিন ‘বি কমপ্লেক্স’ শিশুর দেহ গঠনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া গর্ভকালীন রক্তপাতের আশঙ্কা থাকে বলে গর্ভের শেষদিকে ভিটামিন ‘কে’ খুবই প্রয়োজন। শিশুর হাড় গঠনের জন্য ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি ভিটামিন ‘ডি’ প্রয়োজন। কারণ এই ভিটামিন খাদ্যের ক্যালসিয়ামকে শোষণ করতে সাহায্য করে। ভিটামিন ‘সি’ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য খুবই প্রয়োজন তাঁর নিজের ত্বক ও নবজাতকের ত্বক এবং চুলের জন্য।

যেসব খাবার থেকে এ ধরনের ভিটামিন পাওয়া যাবে সেগুলো হলো দুধ, মাখন, ডিম, ছানা, কডলিভার অয়েল, ইলিশ মাছ, টমেটো, গাজর, পালংশাক, বিট, লালশাক, মাংস, বিভিন্ন ধরনের ডাল, আলু ইত্যাদি। বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি যেমন কমলালেবু, টমেটো, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, আমলকী, পেয়ারা, বরই ইত্যাদি থেকে। দৈনিক ৮০ থেকে ১০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন গ্রহণ করা উচিত।

লৌহ ও ফলিক এসিড :

গর্ভ ধারণের আগেই ফলিক এসিড ও লৌহসমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়া উচিত। কারণ গর্ভকালীন এই দুটির ঘাটতি বেশি দেখা যায়। লৌহ ও ফলিক এসিড আছে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, চালতা, গুড়, কলিজা, পাকা কলা, খেজুর, আম, টমেটো, তরমুজ, সবুজ শাকসবজি, কালো কচুর শাক ইত্যাদিতে। গর্ভকালীন প্রথম তিন মাসে প্রতিদিন ৬০০ মাইক্রো গ্রাম ফলিক এসিড ও ২৭ মিলিগ্রাম লৌহ প্রয়োজন।

ক্যালরি :

গর্ভবতী মায়েদের ক্যালরির প্রয়োজন অন্যদের চেয়ে বেশি। এ জন্য প্রথম তিন মাসে খেতে হবে গর্ভ ধারণের আগে প্রতিদিন যতটুকু ক্যালরিযুক্ত খাবার খেয়েছেন ততটুকুই। পরবর্তী তিন মাসে প্রয়োজন দৈনিক অতিরিক্ত ৩০০ ক্যালরি এবং শেষ তিন মাসে প্রয়োজন দৈনিক আরো ২০০ ক্যালরি।

সুতরাং প্রথমে তিনি যদি ১৪০০ ক্যালরিযুক্ত খাবার খেতেন, তাহলে তাঁকে দিতে হবে দ্বিতীয় তিন মাসে ১৪০০+৩০০=১৭০০ ক্যালরি, পরবর্তী তিন মাসে দিতে হবে ১৭০০+২০০=১৯০০ ক্যালেরিসমৃদ্ধ খাবার। যদি গর্ভবতী মা প্রথম তিন মাসে ১৬০০ ক্যালরি পেয়ে থাকেন তাহলে তিনি শেষ তিন মাস পাবেন ২১০০ ক্যালরি। এই ক্যালরি বাড়ানো উচিত প্রোটিন বা আমিষজাতীয় খাবার থেকে। কারণ প্রোটিনযুক্ত খাবার দিয়েই ভ্রূণের বৃদ্ধি ঘটে থাকে।

গর্ভকালীন ৯ মাসে মোট ওজন বাড়া উচিত ১০ থেকে ১২ কেজি। এর চেয়ে বেশি বাড়লে সুস্থ সন্তান জন্মদানে যেমন প্রতিকূলতা দেখা দিতে পারে, তেমনি পরবর্তী সময়ে মায়ের ওজন স্বাভাবিকে ফিরিয়ে আনাও কঠিন হবে। তাই এ ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

যাদের ওজন আগে থেকেই বেশি তাদের গর্ভকালীন ওজন পাঁচ থেকে আট কেজি পর্যন্ত বাড়তে পারে। যাদের ওজন আগে থেকে অনেক কম তাদের ওজন ১৫ কেজি পর্যন্ত বাড়লে ক্ষতি নেই।

গর্ভাবস্থায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মায়েদের হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখা যায়। ফলে দেখা দেয় রক্তস্বল্পতা। কারণ এ সময় গর্ভস্থ শিশুর দেহে লৌহের চাহিদা মেটানোর পর মায়ের রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যেতে দেখা যায়। বাংলাদেশে ৭৫ শতাংশ গর্ভবতী কোনো না কোনো মাত্রায় রক্তস্বল্পতায় ভুগে থাকেন। রক্তস্বল্পতার ফলে দুর্বলতা, মানসিক অবসাদ বা ক্লান্তি, বুক ধড়ফড় করা, মাথাঘোরা ইত্যাদি দেখা যায়। কলিজা, ডিমের কুসুম, মাংস, কালো ও সবুজ কচুর শাক, বিট, লেটুসপাতা, হলুদ ইত্যাদি খাওয়া উচিত। এ ছাড়া প্রতিদিনই একটি বা দুটি টক ফল খাওয়া ভালো।

তথ্য এবং ছবি : গুগল

Leave a Comment