নিউমোনিয়া কি? এর কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ

  • রেজবুল ইসলাম 
  • এপ্রিল ১৯, ২০১৮

প্রথমে আমদের জানতে হবে নিউমোনিয়া কী? 

ফুসফুসের এক ধরনের ইনফেকশনের নাম নিউমোনিয়া। এটি সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহের জন্য হয়ে থাকে, মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় রেসপিরেটরি ট্রাক্ট ইনফেকশন (Respiratory tract Infection)। এই প্রদাহ যখন জীবাণুঘটিত বা সংক্রমণজনিত হয়ে রোগ তৈরি হয় তখন এটাকে নিউমোনিয়া বলে। 

নিউমোনিয়া কি শুধু বাচ্চাদের হয়? 

নিউমোনিয়া ছোট বা বড় যে কারোর হতে পারে তবে বাংলাদেশে বাচ্চাদের নিউমোনিয়ার প্রবণতা বেশি। অনেক বাচ্চাকে নিয়ে বাবা-মায়েরা ডাক্তারের কাছে দৌড়ান নিউমোনিয়ার চিকিৎসা করাতে। 

নিউমোনিয়া কীভাবে হয়? 

নিউমোনিয়া হতে পারে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, পরজীবী- যেকোনোটি দিয়েই। সাধারণত বেশির ভাগ নিউমোনিয়া হয় অ্যাডেনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, আরএস ভাইরাস, প্যারা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দিয়ে। ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়ার মধ্যে স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি, হিমেফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, নাইসেরিয়া মেনিনজাইটিডিস অন্যতম।

নিউমোনিয়ার লক্ষণ কী? 

জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর প্রথম দিকে সর্দি-কাশির মতো সাধারণ উপসর্গ থাকে। এর দুই থেকে তিন দিন পরই নিউমোনিয়ার প্রকৃত রূপ দেখা দেয়। তবে কোন জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। যেমন- আরএস ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হলে চার থেকে ছয় দিন সময় লাগে, ফ্লু ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হলে এক থেকে তিন দিন সময় লাগে। ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়ায়, শরীরে জীবাণু প্রবেশের পর রোগ প্রকাশ হতে এক দিন থেকে শুরু করে দুই সপ্তাহ সময় লাগে। নিউমোনিয়া শিশুদের জন্য ভয়াবহ রোগ। এটা হলে শিশুরা মারাত্মকভাবে ভুগে থাকে, আবার অনেক ক্ষেত্রে শিশু মারাও যায়। এ কারণে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এই নিউমোনিয়া।

শিশুদের নিউমোনিয়ার লক্ষণ খুবই সাধারণ ও পরিষ্কার, যেটা সাধারণ মানুষও ধরতে পারবে। এ জন্য একটু লক্ষ রাখাই যথেষ্ট। নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো হলো-

- জ্বর, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার হয়ে থাকে, কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত নেওয়া, শ্বাস গ্রহণের সময় বাঁশির মতো শব্দ হওয়া, শ্বাস নিতে কষ্টবোধ বা কষ্টকর শ্বাস-প্রশ্বাস, বুকের খাঁচা দেবে যাওয়া, বুকে ব্যথা, খেতে না চাওয়া বা খেতে না পারা, শিশুর চঞ্চলতা কমে যাওয়া বা নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, বমি করা।

- নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস খুব দ্রুত হয়। দুই মাসের কম বয়সী শিশুদের মিনিটে ৬০ বার বা তার চেয়ে বেশি শ্বাস নিতে দেখা যায়। দুই মাস থেকে ১২ মাস বয়সী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু মিনিটে ৫০ বার বা তার চেয়ে বেশি শ্বাস নেয় এবং এক বছরের বড় শিশু ৪০ বার বা তার চেয়ে বেশিবার শ্বাস নেয়। দ্রুত শ্বাসের সঙ্গে বুকের খাঁচা দেবে যাবে, নাকের লতি উঠা-নামা করবে। নিউমোনিয়া বেশি হলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে শরীরের রং নীলাভ হয়ে যেতে পারে, যা সায়ানোসিস (Cyanosis) নামে পরিচিত।

- শ্বাসকষ্টের সময় কাশির পরিমাণ বাড়ে এবং অতিমাত্রায় জ্বরের কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু খাবার খেতে চায় না।

শিশুরা কেন নিউমোনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয়?

শিশুরাই সহজে ও ঘনঘন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় বেশি। কারণ নিউমোনিয়া একটি বায়ুবাহিত রোগ; সুতরাং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত একটি শিশু যখন হাঁচি-কাশি দেয় বা নিঃশ্বাস ছাড়ে অথবা কথা বলে এর থেকে জীবাণু বের হয়ে বাতাসে মিশে যায়, আর ওই জীবাণুমিশ্রিত বাতাস যে শিশু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করবে সে শিশুটিও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়া সর্দি-কফের সরাসরি সংস্পর্শেও রোগটি হতে পারে। শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা এ কারণে বেশি হয় যে প্রথমত বড়দের তুলনায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা কম থাকে। শিশুরা একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করে। যেমন- স্কুলে খেলাধুলার সময়। এভাবে একটি আক্রান্ত শিশু থেকে অন্য আরো শিশু আক্রান্ত হতে পারে।

নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করার উপায় কী? 

নিউমোনিয়ার কিছু ভ্যাকসিন বের হয়েছে। এই ভ্যাকসিনগুলো যদি সময়মতো নেওয়া যায়, তাহলে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা যায়। এ ছাড়া সুস্থ শিশুকে  নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর কাছে যেতে না দেওয়া; 

হাঁচি-কাশি আক্রান্ত লোকের সামনে বাচ্চাদের যেতে না দেওয়া; 

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। অর্থাৎ বাইরে থেকে এসে হাত-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলা। 

যখন নিউমোনিয়ার প্রকোপ বেশি, যেমন শীতকালে, তখন শিশুকে ভিড়ের মধ্যে অর্থাৎ বেশি লোক সমাগমের মধ্যে যেতে না দেওয়া। যেমন- শপিং মল, সিনেমা হল, বাস ইত্যাদি এড়িয়ে চলা এবং ৫. যথাযথ পুষ্টির মাধ্যমে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা যায়।

বয়স ছয় মাসের কম এমন বাচ্চারা যদি বুকের দুধ পান করে, তবে সে নিউমোনিয়ার জীবাণু অনেকটাই প্রতিহত করতে পারবে। যে বাচ্চার বয়স ছয় মাসের বেশি, তাদের যদি বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার হিসেবে দেশীয় খাবার, যেমন খিচুড়ি, দেশি ফলমূল, শাকসবজি খাবারের মাধ্যমে শিশুর পুষ্টি ঠিক রাখা যায়, তবে নিউমোনিয়ার জীবণু প্রতিহত করার ক্ষমতা আরো বাড়বে। মনে রাখা দরকার, অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হলে বাচ্চাদের ঘনঘন নিউমোনিয়া হয়। তাই শিশুর যথাযথ পুষ্টির দিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে।

নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন পাওয়া যায় কি?

নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন আছে। হিব ভ্যাকসিন ও নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন। হিব ভ্যাকসিন দেড় মাস বয়সেই নিতে হয়। দেড় মাস বয়স থেকে সরকারি যে টিকা দেওয়া হয় সেটি পেন্টা (Penta Valent Vaccine) নামে পরিচিত। এই ভ্যাকসিনে একই সঙ্গে পাঁচটি রোগের টিকা বিদ্যমান। এটা যদি নেওয়া হয়, তাহলে তার কিছু দিন পর থেকে হিবজনিত নিউমোনিয়া থেকে শিশুকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। নিউমোকক্কালজনিত নিউমোনিয়া মারাত্মক একটি রোগ। তাই নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন নিয়ে এটা প্রতিরোধ করা ভালো। এ ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সের আগে নিলে তিন ডোজ লাগবে। ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে নিলে দুই ডোজ লাগবে। আর এক বছর পরে নিলে এক ডোজ লাগবে। আর মিজেলস বা রুবেলা ভ্যাকসিনও যদি কেউ নিয়ে থাকে, এটাও কিন্তু পরোক্ষভাবে নিউমোনিয়ার হাত থেকে শিশুকে রক্ষা করে।

 

Leave a Comment