বুকের দুধ খাওয়ানো মায়ের যত্ন  

  • তন্ময় আলমগীর
  • অক্টোবর ৩১, ২০১৮

মায়ের স্তনই পৃথিবীর সবচাইতে দামী কারখানা, যেখানে নবজাতকের খাদ্য উৎপাদন হয়। মা-ই একে তৈরি করেন। বহন করে নিয়ে চলেন, তার পরিচর্যা করেন। মা-ই তার খাদ্যের মাধ্যমে এর কাঁচামাল সরবরাহ করেন, দুধ তৈরি করেন, তার শিশুকে সরবরাহ করেন প্রয়োজন মত। তবে একথা সত্যি যে, মা যদি একবেলা না খান, তবু বুকের দুধের কোন হেরফের হবে না। তবে বরারবরের মত দুধের উৎপাদন ঠিক রাখতে গেলে মায়ের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। মাকে ঠিকমত খাবার খেয়ে এই কারখানার কাঁচামালের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। তবেই সঠিক গুন সম্পন্ন, সঠিক পরিমাণের দুধ উৎপন্ন হবে।  মায়ের যেসব খাবার বিশেষ দরকার। খুব সংক্ষেপে বললে এ সময়ে মাকে অনেক তরকারি, সবুজ শাকসবজি ও ফল খেতে হবে।

ক্যালোরি : স্বাভাবিক অবস্থায় যে পরিমাণ ক্যালোরি দরকার হয়, বুকের দুধ খাওয়ালে তার চেয়ে অতিরিক্ত ৫০০ ক্যালোরি বেশী দরকার হয়। মোটামুটি ২০০০-২৫০০ ক্যালোরির খাদ্য মাকে প্রতিদিন খেতে হবে। তবে অতসব বিচার না করে খিদে পেলেই মা খাবে, এভাবে চললেও হয়। গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন বাড়ে। এই ওজন কমানো দরকার। কিন্তু শিশুর জন্মের প্রথম দু মাসে খাবার কমিয়ে বা ক্যালোরি কমিয়ে ওজন কমানোর দরকার নেই। দু মাস পর থেকে ধীরে ধীরে ১ বছরের মধ্যে ওজন কমানোর পরিকল্পনা করতে হবে।

প্রোটিন : বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের বেশী প্রোটিন লাগে। প্রোটিন যেমন দুধের সঙ্গে ক্ষরিত হয়ে শিশুর শরীরের গঠনে এবং মেরামতির কাজে লাগে, তেমনি মায়েরও কাজে লাগে। প্রাপ্তবয়স্কা মহিলাদের স্বাভাবিক অবস্থায় দিনে প্রোটিন লাগে ৫০ গ্রাম, গর্ভবতী অবস্থায় দৈনিক ৬৫ গ্রাম আর বুকের দুধ খাওয়ালে লাগে ৭৫ গ্রাম। স্বাভাবিকের চাইতে ২৫ গ্রাম বেশী। যেসব খাবার বেশী প্রোটিন রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, বিন বা সিম জাতীয় খাদ্য, সয়াবিন ও বাদাম। রুটি ও পাস্তার মধ্যেও যথেষ্ট প্রোটিন থাকে।

ফ্যাট : প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলাদের স্বাভাবিক অবস্থায় দিনে ফ্যাট লাগে ২০ গ্রাম, গর্ভবতী অবস্থায় দৈনিক ৩০ গ্রাম আর বুকের দুধ খাওয়ালে লাগে ৪৫ গ্রাম। দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালোরির ১৫-২৫ শতাংশ এই ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাবার থেকে আসা উচিত। যে সব খাবারে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আছে, মায়ের সেই সব খাবার বেশী খাওয়া উচিত। মাছের তেল, কিছু সামুদ্রিক মাছ, বাদাম, অ্যামণ্ড, আখরোট ইত্যাদিতে এই ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বেশী থাকে।

ফলিক অ্যাসিড : এটা একটা ভিটামিন। শিশুর ও মায়ের জন্য দরকার হয়। প্রতিদিন দরকার ৪৫০-৫০০ মাইক্রোগ্রাম। শাকসবজি, বিন, বাদাম, ইস্ট ইত্যাদিতে ফলিক অ্যাসিড থাকে।

আয়োডিন : আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য দরকার হয়। এই হরমোন আমাদের শরীরের পুষ্টি, বিকাশ ও বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত। বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের দৈনিক ১৯০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিনের দরকার। সামুদ্রিক খাদ্যবস্তুতে, দুধে ও সবজিতে আয়োডিন থাকে।

জিঙ্ক : একটা ধাতব পদার্থ। বিভিন্ন উৎসেচকের তৈরির জন্য ও কাজের জন্য জিঙ্কের দরকার। মায়দের প্রতিদিন ১০-১২ মিলিগ্রাম জিঙ্কের দরকার। দানা শস্য, মাংস, দুধ, সামুদ্রিক খাবার, বাদাম ইত্যাদিতে জিঙ্ক থাকে।

ভিটামিন এ : ভিটামিন এ শরীরের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, চোখের গঠন ঠিক করে, প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। মায়েদের দৈনিক দরকার ৮০০-১০০ মাইক্রোগ্রাম। দুধ, ঘি, চিজ, তেলের মাছ, হলুদ- কমলা রঙের তরকারি, গাজর, কুমড়ো, আম ও অন্যান্য তরিতরকারিতে ভিটামিন এ বেশী পাওয়া যায়।

ভিটামিন বি-৬ : শরীরে প্রোটিনের বিপাক ও লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতে ভিটামিন বি-৬ দরকার হয়। দুধ খাওয়ানো মায়েদের দৈনিক ১.৭-২.০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-৬ দরকার হয়। মাংস, মাছ, দানা শস্য ও সিম জাতীয় খাদ্যে ভিটামিন বি-৬ বেশী পাওয়া যায়।

পানি : শরীরের স্বাভাবিক অবস্থায় যে পানির দরকার হয়, বুকের দুধ খাওয়ালে তার চেয়ে কমপক্ষে ৭০০ মিলিলিটার পানি বেশী দরকার হয়। সারাদিন কমপক্ষে ৮-১২ গ্লাস পানি খাওয়া দরকার। বেশি খেলে আরও ভালো। বিশুদ্ধ পানি বা দুধ, ফলের রস ইত্যাদি পানীয় হিসাবে এই পানি খাওয়া যেতে পারে।

ফাইবার জাতীয় খাবার : যেসব খাদ্যে ডায়েটারি ফাইবার (তন্তু জাতীয় দ্রব্য) আছে, মায়ের সে সব খাবার যথেষ্ট পরিমাণে খাওয়া উচিত। ফাইবার এক ধরনের কার্বোহাইড্রেট খাবার, যা বিভিন্ন সবজিতে থাকে। মানুষের পরিপাকতন্ত্র এই খাবার হজম করতে পারেনা, ফলে ফাইবার মলের সঙ্গে নির্গত হয়। তাই ফাইবার পায়খানা পরিষ্কার করে এবং মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্য দুর করে। ফল, শাকসবজি, বিন, ডাল, আটার রুটি ইত্যাদিতে যথেষ্ট পরিমাণ ফাইবার থাকে।

খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন : মা এক সঙ্গে খুব বেশী করে দিনে দুতিনবার না খেয়ে, বারবার ২-৩ ঘণ্টা অন্তর অল্প পরিমাণে খাবার খেলে ভালো। এতে মায়ের বেশী খাবার প্রবণতা কমে, সারাদিন শরীরের বিপাক ক্রিয়া সচল থাকে- যা মায়ের এবং শিশুর পক্ষে ভালো। কাজেই মাকে প্রয়োজনে তার খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে।

বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের খাবার : কিছু কিছু খাবার আছে, যা বুকের দুধের জোগান বাড়িয়ে দেয়। এর বেশিরভাগই বিভিন্ন গবেষণায় বা পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু কোন খাবারের কি রাসায়নিক উপাদান শরীরের কোন অংশে কাজ করে এবং কিভাবে দুধ বাড়ায়, সে সব তথ্য সব জানা নেই। যে সব উপমহাদেশীয় খাদ্য দুধের জোগান বাড়ায় বলে মনে করা হয়, সেগুলো হলো- যব, ওটমিল, বাদামি চাল, পেঁপে, লাউ, ইত্যাদি। এছাড়া মেথি, মৌরি, জিরা, তিল, তুলসী ইত্যাদি মসলা জাতীয় খাদ্যেরও এই গুন আছে বলে বলা হয়। এগুলো নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা এখনো হয়নি। এগুলো ছাড়াও মায়ের ও শিশুর যথেষ্ট পুষ্টি লাভের জন্য বিট, গাজর, মিষ্টি আলু, পালং শাক, মসুর ডাল, অ্যাসপারাগাস, অ্যামণ্ড, অ্যাপ্রিকট, তরমুজ ও খরমুজ উপকারী ভালো খাদ্য।
 

Leave a Comment