শীতকালে  শিশুর নিউমোনিয়া

  • অনলাইন ডেস্ক
  • নভেম্বর ৫, ২০১৮

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই অসুখ নীরবে হয়ে আপনা-আপনিই সেরে যায়। তবে কখনো কখনো আবার গুরুতর আকার ধারণ করে প্রাণনাশেরও কারণ হয়ে ওঠে। অন্যান্য সময়ের চেয়ে শীতকালে নিউমোনিয়ার প্রকোপ বেশি দেখা দেয়।

নিউমোনিয়ার কারণ : ফুসফুসের প্রদাহজনিত অসুখ নিউমোনিয়া, যা বিভিন্ন অণুজীবাণু দ্বারা হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে বয়সভেদে রোগজীবাণুতে কিছু পার্থক্য থাকে। নিউমোনিয়ার সর্বাধিক কারণ হচ্ছে স্ট্রেপটোনিউমোনিয়া ও হিমোফাইলাস (প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে)। দ্বিতীয় কারণ ভাইরাস (৩০-৩৫ শতাংশ)। স্কুলগামী শিশুদের এ-টিপিক্যাল নিউমোনিয়া বেশি দেখা যায়, যা মাইকোপ্লাজমা ও লিজিওনেলা অণুজীবাণুঘটিত। রোগজীবাণুজনিত আরো যেসব কারণ জড়িত, তা হলো:

০-৩ মাস বয়সে : গ্রাম নেগেটিভ এনটেরোব্যাকটেরিয়া, ক্লেমাইডিরা, স্ট্রেপটোকক্কাই, হিমোকাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা (টিকা আছে), স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া, লিসটেরিয়া মনোসাইটাজেন।

৩ মাস-৫ বছর : স্ট্রেপটোনিউমোনিয়া, ভাইরাস, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, স্টেফাইলোকক্কাস, মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া।

৫ বছরের বেশি বয়স : স্ট্রেপটোনিউমোনিয়া, মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া, ভাইরাস, স্টেফাইলো, স্ট্রেপটোপাইওয়েজেনস।

নিউমোনিয়ার ধরণ :

সাধারণ নিউমোনিয়া : এতে শিশুর জ্বর সাধারণত ৩৮.৫০ সেন্টিগ্রেটের কম থাকে। বুকের দুধ পানে অসুবিধা হয় না ও শরীরে পানিস্বল্পতা থাকে না, তবে কাশি ও শ্বাসকষ্ট থাকে।

মারাত্মক নিউমোনিয়া : শিশুর শরীরের তাপমাত্রা হয় ৩৮.৫০ সের বেশি। খাবার খেতে বা বুকের দুধ পানে অসুবিধা হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বুকের নিচের অংশ দেবে যায়। শরীরে পানিস্বল্পতা হয়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বুকে কফ জমে। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯২ শতাংশ বা কম হয়।

অতি মারাত্মক নিউমোনিয়া : এটা হলে খাবার খেতে ও বুকের দুধ পানে বেশ অসুবিধা হয়। শিশুর চৈতন্য লোপ পায়। মাঝেমধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ঠোঁট ও জিহ্বা নীলচে রং ধারণ করে। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯২ শতাংশের কম হয়।

নিউমোনিয়ার লক্ষণ : 

- জ্বর থাকে ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর (৩৮.৫ ডি. সে.)। তবে মারাত্মক নিউমোনিয়ায় ১০০-১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি জ্বর ওঠে।
কম বয়সের শিশুরা নিউমোনিয়ায় হঠাৎ আক্রান্ত হয়।

- কয়েক দিন থেকেই সর্দি-কাশি থাকে।

- বুকের দুধ বা পানীয় পানে অনীহা থাকে।

- দ্রুত শ্বাস নেওয়া বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বুকের নিচের অংশ ভেতরে দেবে যায়।

- চৈতন্য লোপ পায়, নীল হয়ে যায়, অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় ইত্যাদি।

- এক্স-রেতে সুনির্দিষ্ট কিছু চিহ্ন মেলে।

যারা বেশি ভোগে :

- স্বল্প ওজনি-অকালজাত (প্রি-ম্যাচিওর) নবজাতক।

- সঠিকভাবে বুকের দুধ পান না করানো শিশু।

- অপুষ্টিজনিত সমস্যা থাকলে।

- ভিটামিন এ, ডি ও জিংকের ঘাটতি থাকলে।

- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, বিশেষত শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস সংক্রমণে বিটা-ল্যাকটম প্রয়োগ করলে।

- ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাসকারী শিশু।

- রোগ প্রতিরোধ শক্তি কম বা ইমিউন সিস্টেম দুর্বল যাদের।

- দূষিত বাতাস বা ধূমপানের পরোক্ষ সংস্পর্শে থাকলে।

কখন হাসপাতালে ভর্তি?

তিন মাসের কম বয়সী শিশু, যারা মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত, অন্য কোনো কঠিন অসুখে ভুগছে, এক বছরের নিচের বয়সীদের শ্বাসের হার মিনিটে সত্তরের বেশি হলে এবং বেশি বয়সী শিশুদের শ্বাসের হার পঞ্চাশের বেশি হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। অক্সিজেন প্রয়োগসহ খাদ্যপুষ্টি, শরীরের জলীয় অংশ বজায় রেখে গাইডলাইন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে।

নিউমোনিয়ার পরীক্ষা : সিবিসি, সিআরপি, ইএসআর। তবে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণের পার্থক্য নির্ণয়ে তেমন সাহায্য করে না। এমনকি রুটিনমাফিক বুকের এক্স-রেও অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না।

চিকিৎসার প্রধান দিক : ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়া পার্থক্য করাটা বেশ দুরূহ। তাই নিউমোনিয়া হলে শিশুর বয়স, অসুখের স্তর, ওষুধের রেসিস্ট্যান্স। সব কিছু বিবেচনায় গাইডলাইন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে। ‘মারাত্মক নয়’ এমন নিউমোনিয়া হলে মুখে খাবার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। তিন মাসের কম বয়সী আক্রান্ত শিশুকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে শিরায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে চিকিৎসা দিতে হবে। প্রয়োজন হলে অক্সিজেন দিতে হবে। খাদ্য-পুষ্টি, তাপমাত্রা, শরীরের সঠিক জলীয় অংশ বজায় রাখতে হবে।

প্রতিরোধে করণীয় :

- জন্মের ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধ পান করান। অন্য কোনো খাবার, এমনকি পানিও নয়।

- ছয় মাস বয়সের পর বুকের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি পরিপূরক খাবার (খিচুড়ি) দিন।

- ঘিঞ্জি, দূষিত পরিবেশে বসবাস, বোতলে করে খাবার বা দুধ খাওয়ানো থেকে শিশুকে রক্ষা করুন।

- শিশুকে অপুষ্টি থেকে সুরক্ষা দিতে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ দিন।

- সময়মতো ও নিয়মিত টিকাগুলো ডিপিটি, হাম, হিব্, নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন ইত্যাদি দিন।

- শিশুকে বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস রপ্ত করান। এতে করে অনেক অসুখবিসুখ থেকে শিশু রক্ষা পাবে।

- ঘরে জ্বরের সাসপেনশন (প্যারাসিটামল), খাবার স্যালাইন সংগ্রহে রাখুন।

- শিশুর সঙ্গে বই পড়া, গান শোনা বা গলা খুলে গান গাইতে পারেন। ভালোবাসা, আদর ও মনোযোগ শিশুকে দ্রুত সুস্থ করার শক্তিশালী ওষুধ।

- অসুস্থ হলে শিশুকে দ্রুত চিকিৎসক দেখান বা হাসপাতালে নিয়ে যান।

Leave a Comment