নিপাত যাক অঘোষিত যৌতুক ও দেনমোহর অত্যাচার

  • রোমানা আক্তার
  • আগস্ট ৩০, ২০১৮

আমার বিয়ের খবর শুনে লোকে যতোটা খুশি হল তার চাইতেও অধিক কষ্ট পেল দেনমোহর শুনে। যেই সমাজে দশ লাখের নিচে দেনমোহর ভাবাই যায়না সেই সমাজে দাঁড়িয়ে নগদ এক লক্ষ টাকা দেনমোহর নিয়ে বিয়ে করাতে আমাকে সবাই পাগল, বোকা, নির্বোধ আরও কত কি বলে দিল। আমি তাদের কথা শুনেই অনেকটা বোকাবনে হারালাম এই ভেবে যে, আমার জীবনের সিকিউরিটি কিনা পাত্র পক্ষের পাঁচ-দশ লাখ টাকা দেনমোহর দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাহলে এতোকাল আমি কিসের পেছনে ছুটেছি? কেন নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য লোক সমাজের প্রতিবন্ধকতা সামলে নিজের স্কিল বাড়ানোর চেষ্টা করেছি? হাজারো রকম ভাবনা ভেবে সবার মুখের উপর বলে দিয়েছি, "যা করেছি বেশ করেছি। ভালোবেসে পাশে থাকলে থাকবে নতুবা চলে যাক  নিজের ভালোলাগার কাছে। দেনমোহর আদায়ের নামে কোন কুলাঙ্গারের চেহারা দেখতে চাইনা।" এগুলো বিবাহ পরবর্তী রিএকশন।

বিয়ের দিন কি হল আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে? আমার পরিবার সমাজের প্রচলিত প্রথায় গা ভাসিয়ে দিয়ে দেনমোহর চাইলেন পাঁচ লক্ষ টাকা। আমার শাশুড়ি মায়ের এক কথা, নগদ যা দিতে পারবেন তাই দেনমোহর ধার্য হবে। কোনরকম বাকি রাখা যাবেনা। ব্যাস..শুরু হয়ে গেল দুই পরিবারের মাঝে মন কষাকষি। কিন্তু সমাধানেতো আসতে হবে। যেহেতু বিয়েটা আমার, দেনমোহর আমার তাই দুই পরিবার থেকেই আমার কাছে মতামত জানতে চাইলো, আমি কত দেনমোহর ডিমান্ড করছি? সোজাসুজিভাবে বলে দিলাম, "দেনমোহর এক টাকা, পাঁচ টাকা, পঞ্চাশ লাখ নাকি পাঁচ কোটি সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। দেনমোহরের চাপে কেউ আমার সাথে থাকুক তা আমি চাইনা, ভালোবেসে থাকলে থাকবে নতুবা চলে যাক যেদিকে খুশি।" আমার কথার সূত্র ধরে দুই পরিবারের সমঝোতায় দেনমোহর নির্ধারিত হল এক লক্ষ টাকা।

আমি জানিনা মানুষ কেন দেনমোহরের পেছনে ছুটে? একটা সংসার ভেঙ্গে যাবার পর দেনমোহর প্রাপ্তির আশায় নির্লজ্জের মত, অসহায়ের মত তার পেছনে ছুটে চলা, অমন বাজে লোকটার মুখ দর্শন করা কি খুব জরুরি? দেনমোহর স্ত্রীর হক, তা ছেলের সামর্থ্য অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয় এবং তা পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক। স্ত্রী চাইলে ক্ষমা করতে পারে। কিন্তু এ যুগে এসে দেখেছি, লাখ লাখ দেনমোহর ততোদিন মাফ থাকে যতোদিন স্বামী আমার। যেই স্বামী অন্যের দিকে যায় অমনি দেনমোহর দাবি শুরু। সামাজিক প্রেক্ষাপটে পতি দেবতা থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে তা মানিনা। আমি এমনো দেখেছি, দেনমোহর পরিশোধের ভয়ে গোপনে অন্য সম্পর্ক চালিয়ে নেয় অথবা স্ত্রীকে দিয়েই তালাক দেওয়ায়। স্ত্রীর তার জীবনে স্বামী পরিচয় শেষ সম্বল ভেবে নামমাত্র করে যায় সংসার, যে সংসারে একটা কাবিননামা ছাড়া আর কোন ভিত্তি নেই।

স্বামী অবশ্যই আমার জীবনে অপরিহার্য কিন্তু বেঁচে থাকার শেষ সম্বল নয়। ভালো মানুষকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, প্রতারককে ঘৃণা করেই দূরে রাখবো। যে প্রতারক আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তার জন্য দু:খ কিসের? যে সংসারে স্বামী-স্ত্রীরর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নেই, ভালোবাসা নেই, সেটা কিসের সংসার? মন যেখানে বিচূর্ণ, চিন্তা যেখানে ভিন্ন, চাওয়া পাওয়া যেখানে অসম্পন্ন, স্বপ্ন যেখানে অপূরণীয়, সেখানে দেনমোহর কি করে একটা মেয়ের সিকিউরিটি হয় আমি জানিনা। এতো মেয়েদের সম্মান দেয়ার নামে তাদের অসহায়ত্বকেই স্পষ্ট করা হচ্ছে। সাবলম্বী হয়েও যেনো হয়ে উঠতে পারলো না স্বামী নামক প্রতারক নির্ভরতাকে ছাড়িয়ে।

যৌতুক কিংবা দেনমোহর প্রথা ছাড়িয়ে কেবলমাত্র আমাদের পারস্পরিক নির্ভরতা, ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস, সম্মান এবং শ্রদ্ধাবোধ থেকেই  আমরা দু'জন একে অপরের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে প্রেমিক প্রেমিকা থেকে হয়ে গেলাম স্বামী-স্ত্রী। এভাবেই থাকতে চাই আমৃত্যু। জয় হোক ভালোবাসার, নিপাত যাক যৌতুক কিংবা দেনমোহরের অত্যাচার।
 

Leave a Comment