একটি শিশু সন্তান যেভাবে নারী হয়ে ওঠে

  • নাদিয়া জান্নাত
  • নভেম্বর ৬, ২০১৮

আমি একজন নারী। একজন নারী মেয়ে বেলা, বালিকা বেলা কিংবা যুবতী হয়ে ওঠার সময় এমনকি বৃদ্ধা অবস্থাতে বিভিন্ন রকম বাজে ঘটনার মুখোমুখি হয়। এসব ঘটনা সব সময় বলা যায় না। মূলত, বলার সাহস থাকে না। আমরা এমন এক দেশে বাস করি যেখানে মুখ ফুটে সত্য বলাতে বড় ভয়।  তবে এই ভয় কাটিয়ে উঠতেই হবে। আর কতদিন এতো মুখ বুজে থাকবো আমরা? আমি কিংবা আমরা সত্যিটা সামনে তুলে না ধরলে আমার বোন, আমার আমার সন্তান আমার মতো পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে বাধ্য  হবে। আমাদের ভাই, আমাদের বাবা, আমাদের প্রেমিক, আমাদের স্বামী, আমাদের সন্তান, আমাদের মামা/চাচা/ ফুপা এদের সামনে তুলে ধরতে হবে আমাদের অভিজ্ঞতা। তাহলে, কোন না কোন শিশু/ বালিকা/ যুবতী/ বৃদ্ধা এ ধরণের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। 

বাসে, অটোতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত রক্ত মাংসের কিছু পুরুষের সাথে পরিচয় ঘটে। তাদের আচরণে আমিও আৎকে উঠি। সবসময় সবটা বলা হয় না। তবে যখন থেকে বুঝি এটা অন্যায় তখন থেকেই প্রতিবাদ করি। নারীদের প্রতিবাদের এই ক্ষেত্রটা আরো ভয়ঙ্কর। যারা প্রতিবাদ করেছেন তারা ভীতিকর রুপ নিশ্চয়ই দেখেছেন।  আজ আমি আমার শিশুকাল এবং কিশোরী বয়সের কিছু ঘটনা বলবো। 

(১)
আমি তখন খুব ছোট। প্লে কিংবা নার্সারিতে পড়ি। বাসায় একজন হুজুর রাখা হলো। সে প্রতি শুক্রবার বিকেলে আমাদের বাড়ি এসে আমাকে আরবী পড়াতো। তাকে নুরু নানু বলে ডাকতাম। আমার মায়ের গ্রামের বাড়ির পাশেই তার বাড়ি।  নুরু নানুদের বাড়ি মানে আমার কাছে একটা আলাদা আমেজ ছিলো। আমের সময় নানু বাড়ি গেলে নুরু নানুর বাড়িতে ছুটে যেতাম। কাঁচামিঠা আম খেতাম। 

সেই নুরু নানু আমাকে পড়াতে আসতেন। আমার পড়তে ভালো লাগতো। একদিন শুক্রবারের বিকেলে সে আমাকে পড়াচ্ছে আর আমার আঙ্গুল গুলো কেমন করে যেন ধরছিলো। সেই ছোট বয়সেই আমার খুব অস্বস্তি হতে থাকে। হুট করে সে আমাকে তার বুকের  কাছে টানে। এই কাছে টানাটা যে নানা আর নাতনীর আদুরে সম্পর্ক নয় তখন কিভাবে যেন সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।  তার গায়ে কামড় দিয়ে আমি চলে আসি। 
এতোটুকু বয়স আমার। আমি ভয় পেয়েছিলাম খুব। আম্মুর কাছে ছুটে এসে বলেছিলাম আমি আর পড়বো না। খুব বকাঝকা করেছিলো আম্মু। একবারো জানতে চায় নি না পড়ার কারণ। এরপর যতবার নুরু নানু পড়াতে এসেছে, আমি পড়েছি কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারি নি। 

শেষ তিন বছর আগে নানুদের গ্রামের বাড়িতে যাই। আমার নানী আর খালারা বলেছিলেন নুরু নানুর চোখে ছানি পড়েছে। সে চোখে দেখে না। আমার কথা নাকি প্রায়ই বলে। কিন্তু আমি সেদিনও আম্মু এবং খালাদের জানাতে পারি নি নুরু নানু আমার চোখে একজন নানু কিংবা শিক্ষক নয়। সে আমার চোখে একজন নিকৃষ্ট পুরুষ। 

(২) 

আমি তখন কেজি ওয়ান। আমার স্কুলটা ছিলো আব্বুর অফিসের একদম পাশে। স্কুলে ক্লাস শেষ হতো বারোটায়। ছুটির পর প্রতিদিন আব্বুর অফিসে যেতাম।  আব্বু যে রুমটাতে বসতো সে রুমের একদম সামনে একটা ফুল গাছ ছিলো। হলুদ রঙ ফুল ফুটতো। আমরা বাচ্চারা ফুল গুলোকে মাইক ফুল বলতাম। 

আব্বুর অফিসের কোয়ার্টারে যে বাচ্চা গুলো থাকতো ওরা আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলো। মাইক ফুল দিয়ে আমি আর সুরভী ফুলকুমারী সাজতাম। একদিন স্কুল ছুটির পর প্রতিদিনের মতো মাইক ফুল দিয়ে খেলছি আমি আর সুরভী। আব্বু পাশে এসে বললো তোমরা খেলো আমি ব্যাঙ্কে যাচ্ছি। কিছু সময়ের মধ্যেই আসবো। আব্বুর চলে যাবার পর আমাদের ছোটাছুটি আরো বেড়ে যায়। আমি গাছটাতে উঠে ফুল ছিঁড়ি। সুরভী নিচে দাঁড়িয়ে ফুল হাতে নিচ্ছিল। তখন, আব্বুর অফিসের এক ভদ্রলোক এসে বলেন মামণী ফুল ছিঁড়তে হয় না। বলেই, সে সুরভীকে কোলে নেয় এবং তার বুকে হাত দেয়। সুরভী এবং আমি ভয়ে চিল্লাতে থাকি। সে ভদ্রলোক আমাকে গাছ থেকে নামিয়ে বলেছিলো আমি তো তোমাদের আঙ্কেল। তোমাদের তো আমি আদর করতেই পারি। সে এই কথাটা বলছিলো এবং দুজনকে জাপ্টিয়ে ধরেছিলো। 

ঠিক তখন তোসাদ্দেক আঙ্কেল চলে আসেন। সে বললেন, ভুট্টু ভাই কি হয়েছে, ওরা কাঁদছে কেন? সেই ভুট্টু আঙ্কেল বলেছিলো, নাদিয়া মামণী গাছে উঠেছিলো। ওকে নামালাম গাছ থেকে। আমার মনে আছে ওই দিন আমি খুব ভয়ে ছিলাম। এই ভুট্টু আঙ্কেলের সাথে এরপর আরো বহুবার দেখা হয়েছে। তার মেয়ে জেসী আপু আমার কয়েক বছরের বড়। খুব আদর করতো আমাকে। বড় হবার পর অনেক বার ইচ্ছে হয়েছে জেসী আপুকে তার বাবার কথা বলি। বলা হয় নি। 

(৩)

আমার আম্মু নানু বাড়ী ছাড়া আমাকে কোথাও থাকতে দিতো না। ছোটবেলায় খুব রাগ হতো আম্মুর ওপর। মনে হতো সবার আম্মু ভালো আমার আম্মু অন্য রকম।  একবার খুব কান্নাকাটি করেছিলাম ফুফুর বাড়িতে রাতে থাকার জন্য। ফুফুও আমাকে রেখে দিলেন। তখন ক্লাস থ্রির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তো ফুফুর বাড়িতে সারাদিন খেলছি, ছোটাছুটি করছি। বিকেলে অামার ফুপাতো ভাই আমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হলো। আমি ভাইয়াকে বলেছিলাম, ভাইয়া ভূতের গল্প শুনবো। সে আমাকে গল্প শোনাচ্ছিল-

একদেশে ছিলো এক পরী। সে পরীটা তোর মতো সুন্দর। পরীটা ছোট ছোট জামা পরতো। আচ্ছা ময়না, তুই ছোট ছোট জামা গায়ে দিবি বড় হলে? আমার বুক ধ্বক্ করে ওঠে। বাজে স্পর্শ, কিংবা বাজে ইঙ্গিত কি ততদিনে আমি বুঝি। আমি কাঁদতে শুরু করি। ভাইয়া আমাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে যায়। সেবার আমি আমার আম্মুকে বলতে চেয়েছিলাম এ সমস্ত কথা। পারি নি। 

(৪)

আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। ও সময়টাতে খুব ঠান্ডা লেগেছিলো আমার। আব্বু আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করছিল। এবারো আমার বুক কেমন করে উঠেছিলো।  মনে হয়েছিলো এই ডাক্তারটাও বাজে লোক। হ্যাঁ, ডাক্তারটা বাজে লোক ছিলো। এখন মেডিকেলে পড়াশুনা করার বদৌলতে জেনে গেছি বুকের আওয়াজ শোনার জন্য ওরকম স্পর্শের প্রয়োজন হয় না। যাই হোক, ক্লাস ফাইভের এই ঘটনা আমাকে বহুদিন ভুগিয়েছে। আমি পুরুষ মানুষ ভয় পেতাম। আব্বুর থেকেও দূরে থাকতাম। আম্মু বিষয়টা বুঝতে পারে। জানতে চায় কি হয়েছে? আম্মুকে সব খুলে বলি। সেদিন আম্মু আমাকে বোঝালো মেয়েদের জন্য পৃথিবীটা ভয়ঙ্কর। তবে, আব্বু, আমার ভাই নাহিদ আমার খালামণিরা আমার বন্ধু। আমার আপন। তাদের দিয়ে আমার কোন ক্ষতি হবে না।

ছোটবেলার এসব ঘটনার প্রভাব একটি শিশুর জীবনে থেকেই যায়। শিশুদের কোমল মন এই বিক্ষপ্ত ঘটনা গুলো ভুলতে পারে না। 
যে দেশে আমরা জন্মেছি সে দেশে আমরা কি কখনো বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচতে পারবো না? যে পুরুষরা একটি শিশু, কিশোরী, কিংবা নারীর সাথে এ ধরণের আচরণ করে তাদের কি একবারো মনে হয় না, তাদের সন্তান, প্রিয় বোন, মা, স্ত্রী কন্যা কেউ না কেউ প্রতিনিয়ত এ ধরণের ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছে? সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাদের কি একবারো সহজ মানুষ হতে ইচ্ছে করে না? তাদের কি মনে হয় না আমরা নারীরা মানুষ, আমাদের বাঁচার জন্য একটি নিরাপদ শৈশব, কৈশোর, এবং একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ প্রয়োজন। আমরা আর কতকাল কুঁকড়িয়ে বাঁচবো? বাসে উঠে আর কতদিন নিজেকে আগলাবো? বাড়িতে,  মার্কেটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে স্বাধীন ভাবে আমরা বাঁচতে চাই। নিজের শরীর আগলে আর কতকাল আমাদের থাকতে হবে?

পুরুষ আপনারা মানুষ হয়ে উঠুন। আমাদের বাঁচতে দিন প্লিজ।

#MeToo আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ুক। কথা বলতে শিখুক নারী। আর চুপ করে থাকা নয়। বেঁচে থাকার  লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে নারীকে কথা বলতে হবে। প্রতিবাদ করা শিখতে হবে। লজ্জা আর ভয়ে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। মুক্তির পথটা সামনেই। মাঝখানের এই দেয়ালটা ভাঙ্গতে হবে আমাদেরকেই।

Leave a Comment