বাবাকে অপমান! কন্যার আত্মহত্যা! দ্বায়ভার কার?

  • ফারজানা আক্তার 
  • ডিসেম্বর ৪, ২০১৮

বাবাকে নিয়ে লিখতে গেলে লেখা আর শেষ হবে না। তবুও কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে যেগুলো বলতে হয়, লিখতে হয়। বিয়ের সময় বাবারা নিজ হাতে নিজের মেয়েকে মেয়ের জামাইয়ের হাতে তুলে দেয়। আমার বাবা সে কাজটি করেন নি। আমার বাবার সাহস হয় নি নিজের মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার। তিনি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমার মা তার মেয়ের জামাইয়ের হাতে আমাকে তুলে দিয়েছেন। 

বিদায়ের মুহূর্তে আমি কান্না করছিলাম, আমার বাবা চুপচাপ ছিলেন। কিছুই বলেন নি। গাড়িতে আমাকে তুলে দিয়ে বাসায় যেয়ে চিৎকার করে কেঁদেছিলেন। মা আর বোনের কাছে শুনেছি বাবার কান্নার কথা। অনেকদিন ধরেই আমি বাসার বাহিরে আছি। পড়াশোনার জন্য বাসার বাহিরে এসেছি। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নিয়েছি, তারপর বিয়ে করে সোজা নিজের সংসারে। বাসায় আর সেভাবে যাওয়া হয় নি, থাকাও হয় নি। 

বিয়ের একদিন আগে অফিস শেষ করে বাসায় গিয়েছি। বিয়েটা যে আমার হচ্ছে তেমন কিছু বুঝে উঠতেই পারি নি। বিয়ের দিন সকালেও নিজের বিয়ে হচ্ছে তেমন কোন অনুভূতি হয় নি। বউ সেজে দিব্যি এই রুম থেকে সেই রুম হেঁটে বেড়াচ্ছি। কিন্তু যেই পাত্রপক্ষ বাসায় যেয়ে উঠলো তখন মনে হলো আমার বাবা মায়ের কাছ থেকে আমাকে কেউ তুলে নিতে এসেছে। আমি আমার মাকে জড়িয়ে ধরে তখন কান্না শুরু করলাম। কাবিনের কাগজে যখন সাইন নিতে আসলো তখন মনে হলো আমার বাবার কাছ থেকে কেউ আমাকে কেড়ে নিতে চাচ্ছে। আমি আব্বুকে খুঁজছিলাম, আব্বু আসার পর আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম। কবুল বলতেই চাচ্ছিলাম না। আব্বু পাশে বসে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আমার মুখ দিয়ে কবুল বলিয়েছেন। 

আমি আব্বুকে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলাম আমি বিয়ে করবো না। ওদের চলে যেতে বলো। আব্বু আমাকে নিষেধ করছিলেন বোকার মতো কথা না বলতে।  আব্বু বলছিলেন, 'তুমি আমার সুশিক্ষিত মা। এমন কথা বলতে হয় না।' আমাদের তিন ভাই বোনের চোখের পানি আব্বু সহ্য করতে পারে না। কিন্তু বিয়ের দিন আমি কাঁদছিলাম আর আব্বু চুপচাপ সামাল দিচ্ছিলেন। সেদিন আমি আমার বোন বা মার সাথেও এতো ইমোশনাল হয় নি, যতটা বাবার সাথে হয়েছিলাম। বিয়ের দিন শুধু আমার মনে হয়েছিলো কেউ একজন আমাকে আমার বাবার কাছ থেকে আলাদা করছে। 

বাবার কাছ থেকে আমাকে আলাদা কেউ করে নি। মেয়েদের প্রতি বাবার আর বাবার প্রতি মেয়েদের আলাদা ইমোশন থাকে এই কথা সবাই জানে। বাবার স্বপ্নটাকে নিজের মধ্যে লালন করছি, এই জন্য প্রতিনিয়ত সমাজের সাথে পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। একজন মেয়েই জানে তার মনের কতটা জায়গা জুড়ে তার বাবা থাকে। 

অরিত্রির মন জুড়েও হয়তো তার বাবা ছিলো। অরিত্রিও হয়তো তার বাবার জন্য পাগল ছিলো। অরিত্রিও হয়তো বাবার স্বপ্নকে নিজের মধ্যে লালন করতো। যে ব্যক্তি বাবার স্বপ্নকে নিজের মধ্যে লালন করে, সেই ব্যক্তি বাবাকে নিজের জন্য নিজের চোখের সামনে অপমানিত হতে দেখলে সহ্য করতে পারে না। অরিত্রি হয়তো বয়সে ছোট কিন্তু এতটুকু বোধ তার মধ্যে হয়েছে। নিজের একটি ভুলের জন্য স্কুলের শিক্ষকদের কাছে নিজের বাবার অপমানিত হওয়ার ঘটনা অরিত্রি মেনে নিতে পারে নি। আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। 


অরিত্রি
 

অরিত্রির আত্মহত্যার দ্বায়ভার কে নিবে? নকল করা অপরাধ, অপরাধের শাস্তি সবাইকে পাওয়া উচিত। নকলের চিন্তা অরিত্রির মাথায় কেন আসলো? সে কি ঠিকভাবে পড়াশোনা করছিলো না? সে কি তার প্রয়োজনীয় গাইডলাইন টুকু স্কুল বা বাসায় কোথাও পাচ্ছিল না? শুধু কি স্কুলের শিক্ষকদের দ্বারা অপমানিত হয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, নাকি বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক কোন ব্যাপারও যুক্ত ছিলো! মনে অনেক প্রশ্ন কিন্তু উত্তর অজানা। 

অরিত্রির মতো কিশোরীদের এমন আত্মঘাতী ঘটনা আমাদের জন্য হুঁশিয়ারি সংকেত। বাবা - মা , ভাই -বোন, শিক্ষক - শিক্ষিকা সবাইকে সাবধান হতে হবে। কোন বয়সের মানুষদের সাথে কতটুকু কথা বলা উচিত, কতটুকু উচিত নয়, কতটুকু অপমান করা উচিত, কতটুকু নয় এই ব্যাপারটা জানা খুব জরুরি।  

Leave a Comment