সমাজের নাকপাশে আর কতদিন বাঁধা থাকবে মেয়েরা?

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • মার্চ ১৬, ২০১৯

ছেলে মেয়ের মধ্যে যে ব্যবধান তা শুরু হয় পরিবার থেকেই। জন্মের পর পরিবারেই প্রথম একটা মেয়ে ভাবতে শেখে শেখে সে মেয়ে, মেয়েদের এটা করতে নেই, ওটা করতে নেই। দিশা আমার চেয়ে মাত্র একবছরের বড় ছিল। একবছর যে খুব বেশি সময় তা কখনোই আমাকে কিংবা দিশাকে ভাবায়নি বরং এর চেয়ে ঢের বেশি ভাবিয়েছে ওর নামটা। আমি খুব আশ্চর্য হয়ে দিশাকে প্রশ্ন করতাম, দিশা কখনো কোনো ছেলের নাম হতে পারে, তোর মনে হয়? মা বাবা কি ভেবে যে তোর নাম রেখেছে কে জানে! 

পৃথিবীর যতো অস্বস্তিকর কথা আছে তার মধ্যে হয়তো এটা একটা, যে কথায় খুব আনন্দেও দিশার কপালে ভাজের রেখা দেখা দিত। তবে আমি বেশ মজাই পেতাম। একবার হুট করে বাবাকেই জিজ্ঞেস করে বসি। বাবা খুব শান্তভাবেই বলে, এসব তুমি বুঝবে না আর বুঝতেও হবেনা ; পড়ায় মন দাও। সত্যিই সেদিনের পর পড়াতেই ডুবে ছিলাম। দিশাকে আপনি, আজ্ঞে করার প্রয়োজন পড়েনি কখনো। একসাথে স্কুল, খেলা, ঘুম, সবটা সময় ; কখনোই তুই থেকে তুমিতে যেতে দেয়নি আমাদের। ওই মাঝেমাঝে আমার উপর রেগে গিয়ে বলত, আমি তোর বড় ভাই হই, সম্মান দিতে পারিস না!

সেদিনের একটা কথায় কেমন যেন ওকে আমার খুব পর মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল দিশা আর আমার মাঝে যেন বিশাল শূন্যতা ঢুকে গেছে কিন্তু তবুও আমি ওকে সম্মান দিতে পারিনি। তুই ডাকটাকে বদলাতে পারিনি তুমি কিংবা আপনিতে! সময়ের সাথে সাথে দিশার অনেক বন্ধু হলো, খেলার সাথী হলো। আমার সাথে খেলায় মেতে ওঠাটাও দিনদিন ভুলে গেল ও। আমি ঘরে পুতুল বউ কিংবা রান্নাবান্না খেলেই একাকী সময় পার করতাম। কোন প্রয়োজনে যদি সহপাঠীদের বাড়ি যেতাম তবে খুব সহজেই মা বলে দিত মেয়েদের বেশি বাড়ির বাহিরে যেতে নেই। আমি এসবের পাত্তাই দিতাম না, মুখ ভেঙচিয়ে নিজের মতো চলতাম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই কথাটাই যেন প্রতি মুহূর্তে আমাকে ঘায়েল করে রাখত। মেয়েদের এভাবে চলতে নেই, মেয়েদের এটা করতে নেই, তুমি মেয়ে!

ছোটবেলায় ফুফুর মুখে যখন গল্প শুনতাম, ফুফু ডানপিটে ছিল বলে তার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তখন ফুফুকে খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করতাম। মেয়ে বলেই কি তোমার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি? ফুফুর সেই নির্বাক চাহনি আজও আমার বুকে চিনচিন ব্যথার সৃষ্টি করে। প্রতিনিয়ত যখন মেয়েদের স্বপ্নভাঙ্গার গল্প শুনি তখন খুব সহজেই ফুফুর মুখটা ভেসে ওঠে আর সাথে উঁকি দেয় প্রশ্ন, মেয়ে বলেই..? দিশার যখন বন্ধুদের হিসাব সে নিজেই জানতোনা তখন মা আমাকে প্রতি সেকেন্ডে মুখস্থ করাতো মেয়েদের কোন বন্ধু থাকতে নেই। তাই হয়তো আমি দিশাকে ছাড়া খুব একা হয়ে পড়েছিলাম অথচ দিশা দিব্যি বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা মস্তিতে মেতেছিল। আমি সেদিনও কাঁদিনি, শুধুই ভেবেছি ; মেয়ে বলেই কি..?

বাবার মৃত্যুর পর যখন জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষ বাবা হারানোর যন্ত্রনা সামলে নেয়ার চেষ্টায় দিনরাত এক করে দিয়েছিলাম। বাবার একমাত্র স্বপ্ন চোখে নিয়ে যখন দিনরাত কেটে গেছে তখন হয়তো মা খুব সহজেই বলে দিতে পেরেছিল। মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে নেই, তুই বরং স্বপ্ন বুকে পুষিষ না। নিজের অজান্তেই যখন নিজেকে কথা দিয়েছিলাম, আমি পড়বো, খুব পড়বো। বাবার একটা মাত্র চাওয়া রাখবো তখন মা পাশে বসে খুব স্পষ্ট আর সহজভাবেই বলেছিল পড়ার পাঠ এবার চুকিয়ে ফেল, তোর আর পড়ে কাজ নেই। কি স্পষ্ট ছিল সেই কথা আর কি দৃঢ়! মা এইকথাটা যতোটা সহজে বলতে পেরেছিল, আমি ঠিক ততটা সহজে কথাটা মেনে নিতে পারিনি। আমার বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে উঠেছিল সেদিন, কথার কাঁটা প্রতি মুহূর্তে আমাকে আহত করতো আরো থেকে আরো। মনে মনে খুব ভেবেছিলাম সেদিন, কই দিশাকে তো কেউ বললো না আর পড়ে কাজ নেই তবে আমাকে কেন! সেদিন এই প্রশ্নটা খুব জেঁকে বসেছিল আমার মাঝে। তাই হয়তো চারপাশের সব না শব্দগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিত, মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে স্বপ্ন দেখতে নেই। মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে বাঁচতে নেই বরং প্রতিনিয়ত বারবার মরতে হয়। মৃত্যুর চেয়ে বাঁচা হয়তো খুব সহজ তাইতো প্রতিনিয়ত আত্নার মৃত্যুতেও মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখে।

বাবার মৃত্যুর বেশকিছুদিন পর শুনলাম পাড়াপড়শি ঘুমোতে পারেনা আমার চিন্তায়, সত্যিই যে আমার এতো শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল হয়তো আমি নিজেই জানতাম না! এতো শুভাকাঙ্ক্ষী আর ভালো চাওয়ার মানুষের ভীড়ে আমি যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। চারপাশে যখন গুঞ্জন উঠতো মেয়েদের এতো পড়তে নেই, এতো পড়ে কোন রাজকার্য করবে শুনি! এতো পড়িয়ে কি হবে, বিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। সেদিনের সেই কথাটা খুব শ্রুতিকটু লেগেছিল হয়তো বোঝা ভাবটার জন্যই। তখন খুব সহজেই মনে প্রশ্ন আসে, মেয়ে বলেই কি এতো দ্বিধা দ্বন্দ, এতো সংশয় আর মাথা ব্যথা! সেদিন খুব করে চেয়েও পাড়াপড়শিদের খুশি করতে পারিনি আমি তাই পড়াশোনাটা ছাড়া হয়ে উঠেনি আর।

সময়ের ব্যবধানে আমার আর দিশার সম্পর্কটা আর আগের মতো নেই। এখন খুব করে চাইলেও আর দিশার সাথে বসে গল্প কিংবা লুডু খেলায় মেতে উঠা যায়না। হয়তো আজকাল দিশার মনে হয়, আমি ওর সাথে খেলার যোগ্যতা রাখিনা কিংবা ওর কথা বোঝার মতো যোগ্যতা হয়নি আমার। খুব করে জানতে ইচ্ছে করে, আচ্ছা সময়ের সাথে কি ভাইগুলো কি এভাবেই পালটে যায়? কেন পালটে যায়, সত্যি কি বোনগুলোকে ভাইদের খুব বেশি অপারগ মনে হয়! এইপ্রশ্ন গুলো দিশাকে করতে গিয়েও পারিনি, যে সম্পর্কে কখনো সংশয় ছিলনা আজ সেই সম্পর্কে ভর করেছে হাজারো অজানা সংশয়। সময়টা নিজের মতো পালটে গেলেও পাল্টায়নি সেই কথাগুলো, যা আজও ক্ষতবিক্ষত করে বারবার। কিন্তু চারপাশের হাজারো বাঁধা আর কটুক্তি থামাতে পারেনি আমাকে। আমার চোখের সামনে  ছোট্টছোট্ট মেয়ের বিয়ে হতে দেখেছি, বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হতে দেখেছি কিন্তু বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়নি। সাহস করে মেয়েরা এগিয়ে আসেনি বাল্যবিবাহ বন্ধে, বাবা -ভাই- সমাজের ভয়ে তাদের পায়ে শেকল পড়িয়ে দিয়েছে। মেয়ে বলে আর কতো এভাবেই সয়ে যেতে হবে সমাজের অন্যায় অত্যাচার।। পরিবার থেকেই শুরু হোক মেয়ে ছেলের বৈষম্য দূর।

 

Leave a Comment