ধর্ষণ এর শেষ কোথায়...?

  • আসমাউল মুত্তাকিন 
  • এপ্রিল ১৮, ২০১৯

সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা পড়া আমার নিত্যদিনের অভ্যাস। প্রতিদিনের মত আজও পত্রিকা খুলে পড়তে বসলাম। চিন্তা করলাম নতুন কিছু করি যা পড়ে সারাটা দিন ভাল কাটবে। পড়ে মনটা তৃপ্তি পাবে কিন্তু সে সাধ্য পত্রিকা তো মেটাতে পারেনা। কারণ এখানকার পত্রিকার সব খবর আগে থেকেই আভাস পাওয়া যায়। আর পত্রিকা খুললে খালি নিহত, দুর্ঘটনা, সন্ত্রাস,নারী-নির্যাতন আরো কত কি খারাপ সংবাদে ভরপুর। পত্রিকায় এসব দেখলে মনে হয় বাংলাদেশে আরো অর্থনৈতিক সামাজিক ও বিভিন্ন দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েছে। এসব সংবাদ পড়লে মনে হয় আশার নিরাশায় বেশি। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে এটা আশার দিক। আর হতাশার দিক হল নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে এসব কমছে না এটা হতাশার দিক। 

এইতো আজ "প্রথম আলো" খুললাম পড়তে বসলাম। সেখানে একটি শিরোনাম এরকম "১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণ।" তাছাড়া আরও রয়েছে নারী ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের খবর। এরকম খবর প্রতিনিয়ত পত্রিকায় পাওয়া যায়। এটা কোন নতুন খবর নয়।পত্রিকা খুললেই আমরা অনেকেই কমবেশি সবাই মনে করি এই খবরটি পত্রিকায় সাধারণ খবর।এ টা  যাবে কিন্তু এটা যে কতটা খারাপ কলঙ্কযুক্ত আমাদের জন্য তা বলার ভাষা রাখে না। এই ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এর শেষ কোথায়..?

ধর্ষণের ঘটনা যখন ঘটে, তখন কেউ কেউ আছেন, এ ঘটনার মূলে নারীদেরকেই দায়ী করেন! তাদের যুক্তি নারীদের চলাফেরা, খোলা-মেলা পোশাক ধষর্ণকাণ্ডে দায়ী! তারা খোলামেলা পোশাক পরে চলাফেরা করে, নিতম্ব দুলিয়ে হেঁটে যায়, তাঁদের উন্মুক্ত পিঠ, চিবুক, উন্নত বক্ষদ্বয় পুরুষের মাঝে কাম উত্তেজনার উদ্রেক হয়! কিন্তু, পুজা কিংবা তার বয়সি যে শিশু এখনো বুঝতে শিখেনি যৌনতা কি, নিতম্ব দুলিয়ে হাঁটতে জানে না, নেই উন্নত বক্ষদ্বয়, সেই শিশুরা কেনো ধর্ষণের শিকার হয়? এর কোনো উত্তর জানা আছে কী?

আবার পশ্চিমা অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনের কারণে ধর্ষণ বা যৌন-নিপীড়নের মতো ঘটনা ঘটছে বলেও দাবী করে থাকেন কেউ কেউ! সত্যিই কী এ কারণ নাকি এসব খোঁড়া যুক্তি ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা’? এসব যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মূলত সেকেলে দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের নৈতিকতার অধঃপতনের কারণে এ ঘটনা ঘটছে।

এছাড়া চলমান আইন প্রয়োগে শিথিলতা, কার্যকর পুলিশি তদন্তে ব্যর্থতা এবং বিচার প্রক্রিয়ার বিলম্ব,  সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা এবং জবাবদিহিতার অভাব এবং নির্যাতিতার ক্ষেত্রে ‘সুরক্ষা’ নীতি না থাকা এবং পুলিশি ‘তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতা’ ধর্ষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।  

শুধু তাই নয়, কোনো কোনো সময় পুলিশ মামলা নিতে দেরি করায় ধর্ষকরা পালানোর সুযোগ পেয়ে যায়। আবার মামলা হলেও ক্ষমতাসীনদের প্রভাবে অনেক মামলা শেষ হয়ে যায়। পাশাপাশি অভিযুক্ত যদি ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়, তবে বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করার প্রবণতা অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে দেখা যায়। ধর্ষণ বা যৌন-নিপীড়নের মত ঘৃণ্য অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে নারীর প্রতি সামাজিক মনোভাবও একটা কারণ। নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়ায় যৌন সহিংসতার ঘটনার বৃদ্ধি পাচ্ছে। শৈশব থেকেই ছেলেরা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। নারীকে সম্মান করার বিষয়ে তারা শেখার সুযোগ পাচ্ছে খুব কম। যৌন শিক্ষা নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে সেগুলোও পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং সচেতনতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়ায় ধর্ষণ বৃদ্ধির আরো একটি কারণ।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসেব মতে, সারাদেশের আদালতগুলোতে দেড় লক্ষাধিক ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন মামলা ঝুলে আছে। এসব মামলার বিচার চলছে কচ্ছপ গতিতে। মামলা নিষ্পত্তির হার প্রতি বছরে ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এরমধ্যে এক হাজারে সাজা পাচ্ছে সাড়ে ৪ জন। ব্রাক-এর একটি গবেষণায় (২০১৪) দাবি করেছিল, ধর্ষণ মামলার ৯৯ শতাংশ আসামীরই শাস্তি হয় না।

ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে গত ২০০১-২০১৫ সাল পর্যন্ত ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন ঘটনায় ২২ হাজার ৩৮৬ জন চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এরমধ্যে মামলা হয়েছে ৫ হাজার ৩ টি। রায় ঘোষণা হয়েছে ৮‘শ ২০ টি। শাস্তি হয়েছে ১ ‘শ ১ জন আসামীর। রায় ঘোষণার শতকরা হার ৩ দশমিক ৬৬ এবং শাস্তির হার দশমিক ৪৫ শতাংশ।

আমাদের সমাজে তরুণী থেকে শুরু করে বয়স্ক নারীরাও ধর্ষণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। অভিযুক্ত ধর্ষকদের বেশিরভাগ সময়েই কোনো শাস্তি হচ্ছে না। যার ফলে এ ঘটনাগুলো ক্রমেই বেড়ে চলেছে। উৎসাহিত হচ্ছে অন্যরাও ধর্ষণ করতে। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর হিসাবে ২০০১-২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে ১০ হাজার ৮৩২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মহিলা পাঁচ হাজার ৭০৫ জন, মেয়েশিশু পাঁচ হাজার ২০, গণধর্ষণ এক হাজার ৭৩৬টি, ধর্ষণের পর হত্যা এক হাজার ৩১২টি।

যে দেশে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা নারী, সে দেশে নারী নির্যাতন, যৌন-নিপীড়ন, ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংস আচরণের মতো ঘৃণ্য কাজ দিন দিন বেড়েই চলেছে আবার এসব ঘটনায় বিচারের হার তলানিতে এ আমাদের জন্য জন্য উদ্বেগের কারণ।

বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় নারী ও শিশু ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু সেই আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক সময় দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভুক্তভোগীরা বিচারের আশা ছেড়ে দেয়। আবার আইনের ফাঁক গলে ধর্ষকরা জামিন পেয়ে বাইরে এসে ফের ধর্ষণ করছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সামাজিক চাপ ও সমাজে নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কার ফলে অনেক নারীই লড়াই করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলেন।

এমন যদি চলতে থাকে, যথাযথভাবে আইনের প্রয়োগ না হয় এবং বিচার নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে ধর্ষণের মত অপরাধ একের পর এক এদেশে ঘটতেই থাকবে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে একটা সময় এ দেশে যৌন-নিপীড়ন, ধর্ষণ মহামারি আকার ধারণ করবে। দেখা যাবে এর থেকে রক্ষা পেতে নারীকে ঘরের চার দেয়ালে মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে হবে। বর্তমান ঘটনাগুলো কিন্তু তেমনই ইংগিত করছে।

যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ঘটনা রোধে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই। অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ সমাজ থেকে হ্রাস পাবে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে একদিন নারীদেরকেই বাধ্য হয়ে পথে নামতে হবে ‘কাটারি’ হাতে নিয়ে এবং পুরুষদের উচিত তাদের নেগেটিভ  মানসিকতা পরিবর্তন  করা।সব সময় পজেটিভ মানসিকতায় থাকতে হবে।

আসমাউল মুত্তাকিন 
শিক্ষার্থী
জার্নালিজম এন্ড  মিডিয়া স্টাডিজ  
মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Leave a Comment