স্বাপ্নিক নারীদের গল্প

  • জান্নাতুন নুর দিশা
  • এপ্রিল ২৪, ২০১৯

এদেশে মেয়েদের দোষত্রুটি যেভাবে ফলাও করে আলোচিত হয়, মেয়েদের সংগ্রামী জীবনের অনিন্দ্য সুন্দর গল্পগুলো সেভাবে কখনোই আলোচিত হয় না, সমাদৃত হয় না ।অথচ এদেশে শ্রমজীবী নারীদের একেকজনের জীবন সংগ্রামের কাহিনী এত বর্ণাঢ্য যে এগুলো অনুপ্রেরণা হওয়ার কথা, এসব গল্প নিয়ে নাটক হওয়ার কথা, এসব সংগ্রাম ছোঁয়া পাওয়ার কথা শিল্পীর রঙ তুলির।

এমন কিছু গল্প আজ লিখবো। এসব গল্পে কোনো কল্পনা নেই, এসব গল্প রূঢ় বাস্তব, এসব গল্প শ্রমিকের, এসব গল্প নারীর, এসব গল্প একটা দেশের, একটা সমাজের অগ্রযাত্রার। গল্পের নায়িকাদের প্রকৃত নাম দেবো না। অবশ্য নামের প্রয়োজনও নেই। আসলে একেকটা গল্প অনেক অনেক সংগ্রামী শ্রমজীবী নারীর তো শুরু করা যাক।

প্রথম গল্পটা চম্পার। চম্পা এসেছে এক পাহাড়িয়া গ্রাম থেকে। এখন নাগরিক জীবনে সে গার্মেন্টস শ্রমিক। চম্পার বয়স তেইশ হবে। ওর মেয়ের বয়স সাত। মেয়েটা ক্লাস ওয়ানে পড়ে। মেয়েকে গ্রামেই রেখে এসেছে নানীর কাছে। চম্পা আর ওর স্বামী শহরে থাকে। ছোট্ট একটা খুপরি ঘরে। চম্পার স্বামী রিকশাচালক। অবশ্য রিকশা সে চালায় না তেমন। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। 

মাস শেষে নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে ছ'টা অবধি পরিশ্রমের বেশিরভাগ টাকা চম্পা তার নেশাখোর স্বামীর হাতেই তুলে দেয়। বাকি টাকা পাঠায় মেয়ের জন্য। পুরো সংসার চালায় এই তেইশ বছরের মেয়েটা। এই মেয়ে জীবনে যত চড়াই উতরাই দেখেছে অনেকে সারাজীবনেও দেখে না। নেশাখোর স্বামীর বেধড়ক মার খেয়ে শরীরে দাগ নিয়ে ফুঁপাতে থাকা চম্পাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে এত সুন্দরী আর স্বাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও কেন অকর্মণ্য স্বামীর মার খাচ্ছে, সে উত্তরে জানায় এই লোকটাই তার জীবন, অনেকে ভাবে গরীবের ঘরে প্রেম নেই, অথচ চম্পাকে তারা যদি দেখতো! চম্পা চাইলেই ফিরে যেতে পারে তার পাহাড় ঘেরা গ্রামে, দিব্যি কাটাতে পারে কাঠুরিয়া জীবন। কিন্তু সে তার মেয়েকে শিক্ষিত করতে চায়, নিজের চেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন দিতে চায়। তাই তার দরকার টাকা, নিজের পবিত্র ঘামের বিনিময়ে তার দরকার অনেক টাকা।

চলুন আরেকটা গল্প বলি। 
মেয়ে দুটো শহরে এসেছিলো চার মাসের জন্য। দুই বোন ওরা। সীমা এস.এস.সি দিয়ে এসেছে, রুমা ক্লাস নাইনে পড়ে। এতিম মেয়েদুটো মামার বাড়িতে মানুষ, থাকে মফস্বলে। পড়াশোনার খরচ মামা আর চালাতে পারছে না। তাই চার মাসের জন্য গার্মেন্টসে চাকরী করতে এসেছিলো দুজন। চার মাস দুই বোন খেয়ে না খেয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকার মত রোজগার করে ফিরে গেছে। এই পরিশ্রমের টাকায় বড় বোন কলেজে ভর্তি হবে, ছোট বোনও ফরম ফিল আপ করতে পারবে। মেয়ে দুটো মেধাবী। এরা একদিন হয়ত অনেক ভালো জায়গায় যাবে। যাবেই ওরা, এমন সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী, সংগ্রামী মেয়েরা যাবে না তো কারা যাবে? 
সেদিন সফলতার স্বর্ণশিখরে দাঁড়িয়ে ওরা হয়ত জাতিকে গল্প বলবে কিভাবে কত পথ মাড়িয়ে সব অনটন আর সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে ওরা এসেছে এতদূর।

আরেকটা গল্প। 
রোকসানা গার্মেন্টস কর্মী। নদী ওদের আশ্রয়, ওদের ভিটেমাটি কেড়ে নিয়েছে। তারপর ওদের আশ্রয় দেয় নি কেউ। না আত্মীয়স্বজন না অন্য কেউ। অসহায় হয়ে শহরে এসেছে। এখন গার্মেন্টসে চাকরী করে রোখসানা। ওর স্বামী রিকশা চালায়। ওদের একমাত্র ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে। গত আট বছরে গার্মেন্টসে চাকরী করে টাকা জমিয়ে গ্রামে কিনেছে জমি, করেছে ঘর। ছেলেকে করাচ্ছে লেখাপড়া। মূল ডিউটির বাইরেও গার্মেন্টসে ওভারটাইমে কাজ করতো বেশি টাকার জন্য রোখসানা। এদের জীবনে কখনো বিশ্রাম দেখবেন না। অবিরাম এরা খেটে চলেছে।

এরকম আরো হাজারো গল্প আছে। লিখতে গেলে ফুরাবে না। সৎ মায়ের সংসারে থাকা শীলার গল্প, যে নিজের সৎ উপার্জনের টাকায় মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে ছোট দুই বোনের। অথবা তাসলিমার গল্প যার একমাত্র প্রতিবন্ধী কন্যাকে চিকিৎসা করাবে বলে দিনরাত খেটেছে গার্মেন্টসে। মেয়েকে সুস্থ করেছে।

পরিশ্রম আর উপার্জন দিয়ে এরা বদলেছে নিজেদের ভাগ্য। এদের পরবর্তী প্রজন্মকে এরা লেখাপড়া করাচ্ছে। এদের পরিশ্রমের উপর দাঁড়াচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এত পরিশ্রম এদেশে আর কারা করে? এত পরিশ্রমী মেয়েগুলোর কাঁধে ভর দিয়েই এদেশ চীন, জাপানের মত উন্নত হওয়ার স্বপ্ন দেখারও সামর্থ্য পাবে একদিন।

এদের ব্যক্তি জীবন যদি কাছ থেকে দেখেন, ভীষণ রকমের মানসিক শক্তি পাবেন। এরা হয়তো কোনো মঞ্চে উঠে কখনো আপনাদের শোনাতে পারবে না নিজেদের সফলতার গল্প, কিন্তু এদের জীবনের চেয়ে বড় মোটিভেশন আর কেউ আপনাদের দিতে পারবে না এদেশে বিশ্বাস করুন! এই চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, ঘুষ, দুর্নীতির নষ্ট সমাজে এইসব মেয়েগুলোর অভিযোগহীন অবিরাম পরিশ্রম নীরবে লিখে যাচ্ছে একটুকরো স্বপ্নিল বাংলাদেশের গল্প।

টি/শা 

Leave a Comment