প্রিয় পুলিশ ভাই,আপনাদের স্যালুট জানাই 

  • ইউসুফ আহমেদ শুভ্র 
  • মে ৯, ২০২০

প্রিয় পুলিশ ভাই,

 

কেমন আছেন আপনারা? কেমন যাচ্ছে সময়? কিভাবে পারছেন এতো দিক সামাল দিতে? জানেন পুলিশ ভাই, আমি না ভীষণ অবাক হই আপনাদের এতো এতো কাজের মধ্যেও হাসিমুখটা দেখলে!কিভাবে পারেন ভাই আপনারা?

দেশে যখন করোনা ভাইরাস আসলো তখন আমি ধরেই নিয়েছিলাম মানুষ লকডাউন মানবে না, আপনারা ধুমসে পিটাবেন,পিটুনি খেয়ে দুই একজন মারা যাবে, তারপর এই নিয়ে টকশোতে গরম গরম কথাবার্তা হবে,আপনাদের পিন্ডি চটকানো হবে। কিন্তু কী আশ্চর্য! আপনাদেরকে নিয়ে টকশোতে আলোচনা হচ্ছে তবে ভিন্ন কারনে। আপনারা লাঠির বদলে মানুষকে বুঝানো শুরু করলেন।গ্রামেগঞ্জে, অলিতে গলিতে আপনারা ছড়িয়ে গেলেন, গান গেয়ে গেয়ে মানুষকে ঘরে থাকার জন্য উৎসাহিত করলেন, আমরা মুগ্ধ হয়ে অন্য এক পুলিশ বাহিনীকে দেখলাম।

তারপর একদিন দেখি সন্তান তার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত  বাবাকে মাঠে রেখে দিয়ে পালিয়ে গেলো আর সেই বাবাকে উদ্ধার করলেন আপনারা, মাকে বনের মধ্যে ফেলে পালিয়ে গেলো সন্তান আর সেই মাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করলেন আপনারা। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি টেলিভিশনের পর্দায়। এই কোন পুলিশ বাহিনীকে দেখছি আমি! এদেকেই কী বলেছিলাম " পুলিশ কোন চ্যাটের বাল"?  লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে আমার।

প্রিয় পুলিশ ভাই, 

এরপর আস্তেধীরে মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে শুরু করলো।এইবার দেখি আরেক কাহিনী। যেই আমরা সামাজিক জীব হিসেবে গর্ব করতাম,সে আমরা পশ্চিমা বিশ্বকে বলতাম আমাদের মতো পারিবারিক বন্ধন আর কোথাও নেই সেই আমরা বাবা মায়ের লাশ নিতে আসি না, সেই আমরা আমাদের পরিজনদেরকে কবর দিতে নিজের এলাকায় জায়গা দেই না। এবার আপনারা আবার সন্তানের ভূমিকায়। আপন সন্তান যখন বাবা মায়ের জানাজায় আসেন না তখন আপনারা সন্তান হয়ে সেই বাবা মায়ের লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেন, সেই বাবা মায়ের জন্য চোখের জল ফেলে স্রস্টার কাছে দোয়া করেন, সেই বাবা মায়ের কবরটাকে একটু যত্ন নিতে আশেপাশের মানুষদেরক অনুরোধ করে আসেন।

প্রিয় পুলিশ ভাই, 

আপনারা যখন মৃত মানুষদের কে কবর দেওয়ার জন্য নিজের তিলে তিলে জমানো টাকা দিয়ে কিনা জমিটুকুও দিয়ে দেন তখন আপনাদেরক মানুষ মনে হয় না,মনে হয় স্রস্টা আপনাদের তার দূত হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।

আপনারা আপনাদের বেতনের থেকে এক দিনের টাকা দিয়ে দিলেন সরকারের ফান্ডে,আপনারা বৈশাখের ভাতাটাও নিলেন না অথচ আমরা সবসময়ই আপনাদেরকে অর্থলোভী হিসেবে গালি দিয়েছি,খারাপ বলেছি,মন্দ কথা বলেছি।পুলিশ ভাই,আমাদেরকে কী ক্ষমা করা যাবে এই অপবাদ দেওয়ার জন্য? আমি আমার জায়গা থেকে হাত জোর করে ক্ষমা চাচ্ছি প্রিয় পুলিশ ভাই, আমাকে ক্ষমা করবেন,প্লিজ।

মানুষ যখন দুই মাসের বেশি ঘরবন্দী,নিম্নবিত্ত মানুষের যখন পেটের ক্ষুধায় রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করলো তখন আপনারাই তাদেকে খাবারের ব্যবস্থা করছেন নিজেদের পকেটের টাকায়। মধ্যবিত্ত মানুষের হাতে যখন চলার মতো টাকা নাই তখন তারা আপনাদেরক গোপনে জানাচ্ছে আর মধ্যরাতে চুপিচুপি আপনারা তাদেরকে খাবার দিয়ে আসছেন।নিজেদের ক্রেডিট নিচ্ছেন না,ছবি তুলছেন না।হিজরা জনগোষ্ঠীর নিজেদের ঘাড়ে করে খাবার দিয়ে আসছেন, প্রান্তিক মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছেন।প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য কয়েক মাস চলার খাবার দিচ্ছেন,করে দিচ্ছেন চিকিৎসার ব্যবস্থা! এতোটা মহানুভব কিভাবে হচ্ছেন প্রিয় পুলিশ ভাই?

আমাদের শহরের প্রতিটা চেকপোস্টে আমরা আপনাদেরকে পেয়েছি, আমাদের প্রতিটা অলিতে-গলিতে আমরা আপনাদেরকে পেয়েছি, আমাদের প্রতিটা প্রয়োজনে আমরা আপনাদেরকে পেয়েছি। এই সেদিনও দেখলাম এক যুবক সর্দি-জ্বর নিয়ে কোন হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে থানায় এসে উপস্থিত হয়েছে।আমি চিন্তা করি,মানুষের ভরসার কোন জায়গাতে আপনারা পৌঁছেছেন যে মানুষ হাসপাতালে ভর্তির জন্যও আপনাদের সাহায্য চায়।এই দুঃসময়ে বাড়িওয়ালা যখন এক মাসের ভাড়া দিতে না পারায় ভাড়াটিয়া কে বাড়ি থেকে বের করে দেই সেখানেও আপনাদেরকে দেখি মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিতে।কোয়ারেন্টাইনে জমির মালিক ঘরে আছে, জমিতে পাকা ভুট্টা।এখানেও এগিয়ে আসেন আপনারা।কৃষকের পাকা ভুট্টা তুলে দেন।এই সময়ে তরমুজ ব্যবসায় সিন্ডিকেটের কারনে দাম বাড়ে,গর্জে উঠে আপনাদের কন্ঠ,ভেংগে যায় সিন্ডিকেট, মুক্তি পায় কৃষক,আপনাদেরক জন্য দোয়ার হাত তোলে।

লকডাউনে যখন গাড়িঘোড়া বন্ধ, একটা মানুষ মামলার কাজে ঢাকায় এসে আটকে যায়।দিনের পর দিন যখন সে মানবেতর জীবনযাপন করে গাবতলী টার্মিনালে তখন খবর পেয়ে আপনারাই নিজেদের জিম্মায় সেই মানুষটাকে বাড়ি পৌঁছে দেন।আঠারো কোটি মানুষের এই দেশে একটা মানুষের মানবিক আহবান ও আপনাদের চোখ এড়ায় না। শুধু কী মানুষ? এই সেদিন দেখলাম নর্দমায় ডুবতে থাকা কুকুরছানাকে দেখে এক পুলিশভাই ইউনিফর্ম নিয়েই ঝাপিয়ে পরেন ময়লা নর্দমায়। উদ্ধার করেন সেই কুকুরছানাদেরকে!খবরগুলো পড়ে আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেছে,প্রিয় পুলিশ ভাই। 

আমাদেরকে ঘরে রাখতে গিয়ে, আমাদেরকে সেবা দিতে গিয়ে আপনাদের শত শত সদস্য আজ করোনায় আক্রান্ত।পরিসংখ্যানে দেখলাম মোট আক্রান্তের দশভাগই আপনাদের।এরই মধ্যে মারা গেছে পাচজন।এই নিয়ে টেলিভিশনে যখন রিপোর্ট দেখছিলাম তখন দেখলাম আপনাদের ব্যারাকের ছবি।কতো কষ্ট করে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে আপনাদের।এতো কষ্ট করে জীবন কে যাপন করে আপনারা হাসিমুখে আমাদেরকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।আপনাদের আক্রান্ত সদস্যদের মধ্যে যারা সুস্থ হয়ে উঠছেন তারা প্রবল সাহস নিয়ে আবার কাজে যোগ দিচ্ছেন।বলছেন, "সেবা করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে যেহেতু এই পেশায় ঢুকেছি তাই আমৃত্যু সেবা করে যাবো!" আপনাদেরক এই সাহসিকতায় আমরা ভরসা পাই প্রিয় পুলিশ ভাই।

প্রিয় ভাই,
আমি আমার নিজের একটা ঘটনা বলি।রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশ তখন স্থবির। এখানে সেখানে বোমা পরে।মানুষ আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে।সেই সময়টা আমাকে টিউশনে যেতে হয়,ভোরে ক্লাস নিতে যেতে হয়।একটু নিরাপদে থাকার জন্য অনেক ভোরেই আমি বের হতাম আর আমাদের গলিতে একজন বয়স্ক পুলিশকে দেখতাম ডিউটি করছেন।আমি একদিন উনাকে সালাম দিয়ে বললাম,আংকেল আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এই দুঃসময়ে আমাদেরকে পাহারা দিচ্ছেন বলে। বিশ্বাস করেন,আমি সেই পুলিশ আংকেলের চোখে পানি দেখেছি।উনি উত্তরে আমাকে কিছু বলতে পারেন নি একটু স্মিত হাসি দেওয়া ছাড়া তবে উনার চোখ পানিতে ভরে উঠেছিল। 

প্রিয় পুলিশ ভাই, 

আমাদের এই দুঃসময়ে আপনারা ডিউটি করছেন তবে আপনাদেরও পরিবার আছে,আপনাদের ঘরেও ছোট ছোট ছেলে মেয়ে আছে,বৃদ্ধ মা বাবা আছেন।আপনাদের কাছের মানুষেরাও আমাদের মতো আপনাদেরকে নিয়ে চিন্তিত থাকেন।একটা রেইনকোট আর কাপড়ের মাস্ক পরে ডিউটি করতে যাওয়ার সময় আপনাদের সন্তানেরাও আপনাদেরকে আটকে ধরেন, ডিউটিতে যেতে দিতে চায় না কিন্তু কর্তব্যের কারনে,দেশের টানে আপনারা আমাদের পাশে এসে দাড়ান।  আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি আমাদেরকে সাহস দেন,আমাদেরকে ভরসা দেন। আমরা জানি আমাদের যে কোন রকমের প্রয়োজনে আমরা আপনাদের ডাকলেই পাবো।আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি আপনারা জেগে আছেন বলেই।

আমাদেরকে এতোটা নির্ভরতা দেওয়ার জন্য আপনাদেরক স্যালুট জানাই, ভাই! আমাদের ভালোবাসা নিবেন।

Leave a Comment