‍‍`একটি হেঁশেলের কথা‍‍`

  • সুমনা বাগচী
  • ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২১

বরিশালের উজির পুর গ্রামে বাস কবিরাজ নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের।সারা গ্রামে তাঁর জাদুকরী ওষুধের খ্যাতি ছড়িয়ে আছে।মাটির দালান বাড়িতে, সব সময় মানুষের ভিড়। দিনের যে প্রহরই হোক না কেন কবিরাজ মশাই কারুর ডাক ফিরিয়ে দেন না। শান্ত ভাবে, চোখে চশমা নামিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, শিকড় ,গাছের ছাল দিয়ে জাদুকরী ওষুধ তৈরির কাজে।

ছয় পুত্র আর এক কন্যা নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। স্ত্রী সুধন্যা সুন্দরী দেবী ছিলেন রুপে গুণে সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী। তাঁর পরম নিষ্ঠা আর আত্মীয়তার কথা সবার জানা ছিল।কোনো অভুক্ত তাঁদের বাড়ী এলে না খেয়ে ফিরে যেতেন না। এই ভাবেই সময় আর দিন এগিয়ে চললো.. সে এক ভারী দুর্যোগ এলো গাঁয়ে। প্রবল বর্ষাতে রাস্তা ঘাট ডুবে গেলো। ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেলো।গৃহস্থ বাড়িতে দুবেলা ভাত ফুটিয়ে খাওয়া চললো।বাড়ির আসেপাশের জমিতে, লাউ, পেঁপে, কুমড়ো,উচ্ছে দিয়ে রান্না করা হতো।

আরো পড়ুনঃ মজাদার স্বাদের কটকটি রেসিপি!

কবিরাজ মশাইয়ের বাড়িতেও সেই এক ভাবেই চলছিল। ছেলেমেয়েদের মুখে একটু জুত করে তোলার মত দুটি ভাত সুধন্যা সুন্দরী দেবী যত্ন করে রেঁধে দিতেন।ওনার খুব বড়ো গুণ ছিল,রান্নার পদের স্বাদ বদলের ক্ষমতা।একটা সাধারণ তরকারি স্বাদে গন্ধে ভরপুর হত। বাড়িতে থাকা গোয়াল ঘরে, গাভীর দুধে তৈরি করতেন, ঘি, মাখন। আর বেশ কয়েকমাস তা দিয়ে রান্না করতেন,গরম ভাতে ঘি দিয়ে ছেলেমেয়েদের খাওয়াতেন। তাছাড়া, আঙুর দিয়ে বাড়িতে তৈরি করতেন কিশমিশ,সাথে আমসত্ত্ব আর হরেক রকমের আচার প্রস্তুত হত। দুধ জ্বাল দিয়ে তাতে কড়া পাক ও নরম পাকের সন্দেশ বানাতেন। এ যেন মা লক্ষ্মীর পরম কৃপা।

বাড়ির ভাঁড়ার কখনো শূন্য হতনা। বাড়িতে চিরে,মুড়ি,আর ঝাল মুড়ি বানিয়ে একটা মাটির পাত্রে রেখে দিতেন।পুকুরের ছোটো মাছ দিয়েও পদ হতো নানা রকম। তাঁর হাতের রান্নার চর্চা চলতো বাড়িতে বাড়িতে। সব মেয়ে বউ রা দুপুরে ভীড় জমাতেন তাঁর রান্নার প্রণালী জেনে নেওয়ার জন্য। তখন, সুধন্যা সুন্দরী দেবী,মাটির দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে,মুড়ি, আম তেল আর মিষ্টি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করতেন। এতটাই গুণবতী ছিলেন তিনি। সেবার, শহর থেকে আগমন ঘটে কবিরাজ মশাই এর আপন পিসির ছেলের। কিছুদিন ধরেই কবিরাজ মশাইয়ের শরীর ভালো ছিল না।

আরো পড়ুনঃ সকালে ঘুম থেকে উঠেই মাথাব্যথা কেন? জেনে নিন কারণ এবং প্রতিষেধক

তাই বাজার করা সম্ভব হয় নি।তার সাথে অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে তিনিও হঠাৎ অসুস্থ হলেন। এই মুহূর্তে ঠাকুরপোকে কী রেঁধে খাওয়াবেন একটু ভাবতে বসলেন সুধন্যা সুন্দরী দেবী। বাড়িতে সবজি বলতে, পেঁপে কুমড়ো আলু পটল কাঁকরোল। এই বার ভাবতে লাগলেন এই দিয়েই কিছু একটা বানিয়ে খাওয়াবেন।  প্রথমে অতিথি কে গরুর দুধের চা,ঝাল মুড়ি আর বাড়ির তৈরি মিষ্টি দিলেন।

পেঁপের পোলাওঃ দুপুরে নিরামিষ রান্নার আয়োজন রাখলেন। রান্না ঘরে নিস্তব্ধতা। সুধন্যা সুন্দরী দেবী আয়োজন শুরু করলেন। পেঁপে মিহি করে কেটে জলে বেশ কিছুক্ষন ভিজিয়ে রেখে দিলেন।তারপর তাঁর বানানো কিশমিশ কৌটো থেকে নিয়ে এলেন।

পেঁপে ভালো করে ধুয়ে জল ঝড়িয়ে রাখলেন। মাটির উনুনে গনগনে আঁচে লোহার কড়াই বসালেন।বাড়ির পাশে থাকা তেজপাতা গাছ থেকে পাতা নিয়ে এলেন। কড়াই গরম হতেই তারমধ্যে দিলেন বাড়ির তৈরি গাওয়া ঘি,তার সাথে দিলেন তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা ও এলাচ। এরপর পেঁপে দিলেন। খুব সুন্দর গন্ধে চারপাশ যেন ভরে গেলো। তারপর চিনি, কিশমিশ ও চিনে বাদাম দিলেন।চললো পাক। আস্তে আস্তে জল কমে গেলো। আর পেঁপে নরম হয়ে এলো। এই বার পিতলের পাত্রে নামিয়ে রাখলেন। আর বাড়ির গাছের নারকেল দিয়ে তা ছোটো ছোটো কুচি করে ছড়িয়ে দিলেন।আর নাম দিলেন,

 এরপর ঝুড়িতে কাঁকরোল নিয়ে তার ভিতরে থাকা দানা বার করে নিলেন।আবার কড়াই তে তেল ঘি একসাথে দিলেন,ফোড়ন দিলেন শুকনো লঙ্কা,কাঁকরোল এর সব দানা দিয়ে তার মধ্যে নারকোল কুড়ানো, ধনে জিরে বেটে,লঙ্কা বাটা ও নুন মিষ্টি দিয়ে পুর করা হলো।আর কাঁকরোল এর মধ্যে তা ঢুকিয়ে ভেজে নেওয়া হলো।বাড়ির পাতা টক দই এর মিশ্রণে প্রস্তুত হলো..

আরো পড়ুনঃ রাতে ভালো ঘুমের পর‌ও সকালে ক্লান্ত লাগে? কারণ ও সহজ সমাধান!

দই কাঁকরোল এর নিরামিষ পুর বানানো হলো। 

ক্ষীরের পায়েসঃঅর্থাৎ দুধ জ্বাল দিয়ে তা ক্ষীরের মত প্রস্তুত করে তার মধ্যে চাল দিয়ে পায়েস হলো। পটল আর আলু দিয়ে, দম বাহারী করা হলো। অর্থাৎ সব মশলা বেটে, তার মধ্যে অর্থাৎ আলু সিদ্ধ করে মশলা একসাথে করে মেখে নিয়ে আর আম তেলের তেল মিশিয়ে ,পটলের মধ্যে পুর ভরে,আরেকটা মনের মত নিরামিষ পদ।তবে এটা ভাজা পটলের মধ্যে নতুনত্ব হিসাবে আচারি স্বাদ। শেষে আরেক প্রস্তুত পদ.... ছানা কেটে নরম সন্দেশ আর ছানা ভাপে। অর্থাৎ একটা বন্ধ পাত্রে ছানা, সর্ষে পোস্ত বাটা,নারকোল কুড়ানো,সর্ষের তেল,কাঁচা লঙ্কা বাটা দিয়ে গরম জলের পাত্রে রেখে দিয়ে ,ভাপে রান্না। এতকিছু করার পর স্নান সেরে, দুয়ার পরিষ্কার করে খাবার দেবার আয়োজন করলেন। অতিথিকে আসন পেতে,পাশে স্বামী ও তাঁর সন্তানদের কাঁসার থালায় খাবার সাজিয়ে দিলেন। কাঁসার থালায়..... সব নতুন পদ। লেবু লঙ্কা, গাওয়া ঘি দেওয়া ভাত, পেঁপের পোলাও, দই কাঁকরোল এর নিরামিষ পুর, পটল আলুর দম বাহারীআমের মোরব্বা, ছানা ভাপে, ক্ষীরের পায়েস, নরম ছানার সন্দেশ তৃপ্তির ছোঁয়ায় চারদিকে ভরে গেলো। এ যেন মা লক্ষ্মীর ভান্ডার।

এত কম জিনিসে এত আয়োজন দেখে অবাক কবিরাজ মশাই। দীর্ঘ দিনের অসুস্থতার পরে, আজ এই খাবারগুলো পরম তৃপ্তিতে ভরিয়ে দিল তাঁর মনপ্রাণ। "ঠাকুরপো, আর দুটো ভাত দি"। উত্তরে ঠাকুরপো বললেন, "বৌদি আজ মা লক্ষ্মীর প্রসাদে মন ভরে গেলো গো।" এতকিছু রান্নার পর অল্প ভাত ও দুধ দিয়ে সুধন্যা সুন্দর দেবী দুপুরের আহার সারলেন। অল্প রান্নার বাজারে অতিথি ও গৃহ স্বামী, সন্তানদের তৃপ্তির হাসি অনেকটাই মন ভরিয়ে দিল তাঁর। এ এক অপার তৃপ্তি।

আরো পড়ুনঃ মাত্র তিন মাসে শিশুর মস্তিষ্কের শক্তি বাড়াবে এই জাদুকরী খাবার!

এতে পেট না মনের অনুভূতি কানায় কানায় পূর্ণ। এরকম গল্পগুলো আমাদের খুব কাছ থেকে শোনা। কারণ সেই মাটির বাড়ির রান্নার হেঁশেল পূর্ণ ছিল ভালোবাসা,ইচ্ছা ও তৃপ্তিতে। অনেক ঘটনা অজানা থেকে যায়। অনেক রেসিপি হারিয়ে যায়.... কিন্তু আজও হেঁশেলে কান পাতলেই, খুন্তি নাড়ানো শব্দ ও রান্নার গন্ধ অনুভব করা যাবে। কারণ, এই ভালোবাসার তৃপ্তি আমাদের মন জুড়ে রয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment