‍‍`একটি বিতর্কের গল্প‍‍`

  • সুমনা বাগচী
  • ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১

রিমা, সবসময় স্পষ্ট কথা বলতে ভালোবাসে। ছোটো বেলা থেকেই সে স্পষ্ট বক্তা। যদিও এই নিয়ে কম ঝামেলা তাকে পোহাতে হয় নি। কিন্তু দিনের শেষে যে শান্তি সে পায়, সেটা শুধু তার মন জানে। সে ছোটো বেলা থেকেই বেশ অন্যরকম। একান্নবর্তী পরিবারের সন্তান সে,ছোটো বেলা থেকেই মা কে দেখতো সংসারের যাঁতাকলে পিষতে। শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেওর ননদ কম যন্ত্রণা দেয় নি তার মা কে। কিন্তু কোনদিন তার মায়ের পাশ থেকে সরেনি। মাও কোথাও তাকে জড়িয়ে শান্তি পেতেন। বাবার থাপ্পড়, মায়ের গালে দাগ স্পষ্ট করে তুলতো। আর রিমা,মায়ের চোখ মুছে বোরোলিন লাগিয়ে দিত। যন্ত্রণা গুলো তার মনে ঘা হয়ে জমে যেত।

এরপর স্কুলে যখন দারোয়ান বাজে ভঙ্গি করে তাকে উত্যক্ত করতো, ছোটো ছোটো মেয়েদের গায়ে হাত দিত, সেই মুহূর্তে প্রতিবাদ করতে থামেনি সে।স্কুলের সবার সামনে চড় মেরেছিল সে। সামনে এসে কেউ পাশে না থাকলেও আড়ালে সম্মতি ছিল সবার। কোথাও তার প্রতিবাদে,সমাজের চোখে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই ভাবেই এগিয়ে চলে রিমা। কর্পোরেট, ঝা চকচকে জায়গায় তার মন টেকেনি।ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী থাকলেও তার মন মিশে যেতে চাইতো সাধারণ মানুষের সাথে। যেদিন বাড়িতে জানিয়েছিল, না আমি আর এই চাকরি করবো না,বাবা মা কেউ সাপোর্ট করে নি। মা বলেছিলেন, "তোর বাবা লোন নিয়ে তোকে পড়িয়েছেন। অত টাকা শোধ করা হলো,আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে তুই চাকরি ছাড়লে?"

আরো পড়ুনঃ বাচ্চার ওজন বাড়ানোর জন্য নিরাপদ ২টি খাবার!

সেদিন কিছু টা হলেও অবাক হয় রিমা। এই সেই মা,যিনি আদর্শ শেখাতেন, "বলতেন মানুষের জন্য ভাবতে হবে তোকে!" সময় মনে হয় মানুষ কে পরিবর্তন করে অনেক টা।তাই সম্পর্ক গুলোর সমীকরণ বদলে যায়। হেসে উত্তর দিয়েছিল রিমা, "তুমি ভেবো না মা, বাবা যখন তোমাকে আঘাত দিত,যখন তুমি চরম যন্ত্রণা সহ্য করতে,ভাবতে ভবিষৎ কি হবে,তোমার কি হবে?,তখনও যখন তোমার পাশে ছিলাম,আজ সময় পরিবর্তনে কিন্তু আমি বদলে যাইনি। তোমাদের ভবিষ্যৎ আমার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।" থমকে যান, রিমার মা।

এরপর ট্রাফিকিং এ ক্ষতিগ্রস্ত বাচ্চাদের জন্য কাজ করে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ যুক্ত হয় রিমা।কাজের জন্য বাড়ি থেকে দূরে থাকে রিমা।বেশি টাকা আয় না করলেও, তার চলে যাওয়ার মত টাকা সে রোজগার করে,আর তাতেই তার শান্তি।প্রত্যেক মাসে রোজগারের অর্ধেক টাকা মায়ের ব্যাংক একাউন্ট এ ট্রান্সফার করে সে। এর সাথে সাথে,তার পছন্দের বিষয়আঁকা, চলতে থাকে আপন ছন্দে।আর সেই আঁকা র মধ্যে ফুটে ওঠে সমাজের কালিমা লিপ্ত পটভূমি। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানো,তাদের সাথে গল্প করা আর কাজ সুন্দর ভাবে এগিয়ে চলে তার প্রত্যহ জীবনে। রাজীবের সাথে আলাপ হয় কাজের সূত্রেই।

রাজীব একজন সাংবাদিক। সমাজে পিছিয়ে পড়া,অত্যাচারিত মানুষদের নিয়ে তার কাজ। দুজনের কাজের মধ্যে এক সুন্দর মিল ছিল আর এভাবেই গড়ে ওঠে তাদের আত্মার মিলন। একটা অ্যাসাইনমেন্টের জন্য রিমা কে যেতে হয় বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।যেখানে আগে থেকেই খবর আসে,কিছু বাচ্চা মেয়ে কে আটকে রাখা হয়েছে আর তাদের খুব তাড়াতাড়ি পাচার করা হবে। রাজীব কে মেসেজ করেই, রিমা রওনা দিলো আরো দুজন সহকর্মী কে নিয়ে।

আরো পড়ুনঃ মাত্র ১৫ মিনিটের যে ব্যায়ামে ক্লান্তি দূর হবে!

একেবারেই সাধারণ পোশাকে, আর সেই অঞ্চলে একজনের বাড়িতে থাকে তারা। রাত তখন দুটো হবে। কিছু লোক কে নিয়ে হাজির হয় সেই গোপন ডেরায়।পুলিশ চারদিকে ঘিরে ধরেছে। আর কিছুটা ধস্তাধস্তি মারামারির পর বাচ্চাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়। সব টাই প্ল্যান মাফিক হলেও, দলের আসল পান্ডা কে পাওয়া যায় না। আর পাওয়া যায় না রিমা কে। জঙ্গলের মধ্যে রিমা দৌড়ে ধরে ফেলে দলের পান্ডা কে। নিরস্ত রিমা। আর দলের পান্ডা র হাতে চক চক করছে ভোজালি। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। রক্তাক্ত রিমা হাল ছাড়েনি।পাশবিক চেহারার রবিন,অত্যাচার চালায় রিমার উপর। সমস্ত রাগ,ঘৃণা,আর হেরে যাওয়ার লড়াই করার জ্বালা নিবারণের উপায় একজন নারী কে শারীরিক ভাবে অত্যাচার। হাল ছাড়েনি রিমা,সমস্ত যন্ত্রণা,লজ্জা কে দূরে সরিয়ে পাশে পড়ে থাকা গাছের শক্ত ডাল দিয়ে রবিনের চোখে ঢুকিয়ে দিল সে।

যন্ত্রনায় চিৎকার করে সরে যায় রবিন। অদূরেই পুলিশ বাহিনী ধরে ফেলে রবিন কে।আর ঠিক ঝোপের ধারে উদ্ধার হয় বিবস্ত্র,রক্তাক্ত রিমাকে। হাসপাতালে সবাই দেখতে আসে রিমা কে। মা মাথার কাছে বসে অঝোরে কাঁদছেন। বাবা বোবা র মত অপলক দৃষ্টিতে রিমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কাগজে রিমাদের সংস্থা কে নিয়ে অনেক লেখালেখি করা হয়।উচ্চ প্রশংসিত হয় রিমার কাহিনী। তবে লেখার মধ্যে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, 'ধর্ষিতা' শব্দ টিতে। হ্যা রিমা দশ জন মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে আর নতুন জীবন দিতে,হাজার যন্ত্রণা আর বিপদের উপস্থিতি বুঝেও হার মানে নি। রিপোর্টার আসে, সবাই বলে মুখে কাপড় দিয়ে কথা বলে... রিমা, সেই বিতর্কে কান দিলো না। স্পষ্ট ভাষায় জানায়, " আমি রিমা, হ্যা আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে,তাতে আমি মোটেই অনুতপ্ত নই।আমার শান্তি, ছোটো ছোটো বাচ্চাদের আবার নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য। ধর্ষণ কোনো নারীর শক্তিকে হারাতে পারে না। শুধুই যন্ত্রণা দিতে পারে। কারণ সমাজ ভাবে একজন নারী কে অত্যাচার করে,মুখ বুজে যন্ত্রণা দেবার উপায়,ধর্ষণ। কিন্তু সমাজ জানে না,নারীর মনন শক্তির কাছে সব কিছুই তুচ্ছ।"

আরো পড়ুনঃ জাপানিজ ডায়েট চার্ট, আয়ু বাড়ান খাদ্যাভ্যাসে!

আমি বিতর্কের মাঝে দাড়িয়েও নিজের প্রাণের বদলে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব মিটতে দেবো না চারদিক নিঃস্তব্ধ। শান্ত। সবার চোখে জল। সবার মনে একটাই প্রশ্ন,এই বিতর্ক কে ধুলিস্যাৎ করে যদি মানুষ এই ভাবে ভাবতে শেখে,তাহলে সমাজে এই বিতর্ক কথাটি কে গুরুত্ব আর কেউ কোনো দিন দেবে না। স্বার্থক নারী। স্বার্থক তাঁর শক্তি। গর্বের সাথে রাজীব সবার সামনে রিমা কে জড়িয়ে ধরে,চোখের জলে বলে, "আমি গর্বিত তোমাকে পেয়ে!" সমাজ পুরুষকে যেমন ধর্ষকের তকমা দেয়,তেমনই ভালোবাসা,আশা, পাশেও থাকে একজন পুরুষ। শুধু বিতর্ক আসে আমাদের ভাবনায়!

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment