বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ুক অফলাইনেও

  • নাজমুল হক
  • মে ২৯, ২০১৮

ঘটনা ১। একটা মেয়ে তার পিরিয়ড চলাকালীন মেয়েকে একটা ট্যুরে ছেলে সহযাত্রীগুলা কিভাবে হেল্প করেছে সেইটা লিখে খুব সুন্দর একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে ।

ঘটনা ২। নতুন প্রজন্মের সবেমাত্র ক্লাস এইটে পড়া একজন তার পিরিয়ডের প্রথমবর্ষ উপলক্ষে বন্ধুদেরকে ট্রিট দিয়েছে।

ঘটনা ৩। গ্রামের একেবারে অক্ষরজ্ঞানহীন এক মহিলার ছেলে মানষিকতায় আধুনিক হয়ে মাকে অন্যান্য স্বাভাবিক বিষয়আশয় এর সাথে পিরিয়ডের ব্যাপারটাও বুঝাতে সক্ষম হয়েছে এবং যার ফল স্বরুপ তার মা তার ছোটবোনের পিরিয়ড সংক্রান্ত জটিলতা তার সাথে শেয়ার করতে দ্বিধা করছে না।

ঘটনা ৪। খুবই স্মার্ট ফ্যামিলির এক গৃহবধু, যে আবার নিজেকে পরিবর্তনের ঝান্ডাদারি মনে করে সে পিরিয়ডের জন্য রোজা না রাইখা কিভাবে নিজেদের ঘরেই লুকোচুরি ও বিভিন্ন চল চাতুরি করছে যাতে করে কেনো রোজা নাই এই প্রশ্নের মুখোমুখি না হতে হয়। এই ঘটনার সাথে মিলিয়ে সে পিরিয়ড সবার হয়, সমাজের মানুষগুলা জানোয়ার, নষ্ট সমাজ ব্লা ব্লা ব্লা সহ খুবই জ্বালাময়ী একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে ফেসবুকে।

গত বছরখানেক যাবত পিরিয়ড সংক্রান্ত বিষয়আশয় নিয়মিত ব্যবধানে টপ অপ দ্যা সোসাল নেটওয়ার্ক ছিলো, এখনো আছে। সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পিরিয়ড নিয়া একটা কঠিন বিপ্লব করে পিরিয়ডের মতো স্বাভাবিক বিষয়কে স্বাভাবিক করার ব্রত নিয়েই সো কল্ড সচেতন সমাজ টপিকটাকে টপ অপ দ্যা সোসাল নেটওয়ার্কে রাখতে চাইছে।

তারই ধারাবাহিতায় উপরের চারটা ঘটনার সাথে পরোক্ষ অথবা প্রত্যাক্ষভাবে আমি পরিচিত।

প্রথম ঘটনাটা আমার ফেসবুকের পরিচিত একটা মানুষের। সে কিছুদিন আগে একটা ট্রিপে গিয়েছিলো এবং তার অনেকগুলা ছেলে ট্রিপম্যাট ছিলো। ঘটনাক্রমে তার তখন পিরিয়ড ছিলো। সে খুবই স্বাভাবিকভাবেই ট্রিপের অ্যাডভেঞ্চারের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সাথে পিরিয়ডের বিষয়টাকে না এড়িয়ে শেয়ার করেছে। এরপর কিছু হাফইঞ্চি পরিমান সংকুচিত মানুষিকতার মানুষ মেয়েটার একা এতগুলা ছেলের সাথে ট্রিপে যাওয়ায় তাকে বিভিন্নভাবে খারাপ প্রমান করতে চাইছিলো, যদিও মেয়েটা এইসব কিছু খুব একটা কানে নেয়ার মানুষ না।

তবুও ওই ঘটনার প্রেক্ষিতেই মেয়েটা তার ট্রিপে পিরিয়ডকে কিভাবে সাইকেল চালিয়ে পা ব্যাথা হওয়ার মতো স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে এবং নাফা এক্সট্রা ও প্যারাসিটামলের মতোই বন্ধুদেরকে দিয়ে স্যানেটারি ন্যাপকিন আনিয়েছে সে অভিজ্ঞতা শেয়ার করে অন্যান্য কিছু মানুষকে বিষয়টাকে কারো কাছে না লুকিয়ে সহজভাবে নেয়ার জন্য উৎসাহিত করেছে। এখানে অনলাইনে শেয়ারের উদ্দেশ্যও সফল কারন সে আগে অফলাইনে পরিবর্তন এনে পরে তা অনলাইনে শেয়ার করেছে সচেতনতার লক্ষে।

দ্বিতীয় ঘটনা আমার এক পরিচিত আপুর। যিনি তার মেয়েকে আধুনিক করে গড়ে তুলছেন। সারাদিন শুধু কোচিং আর ক্লাসের পেছনে না দৌড়াইয়া জীবন চেনাচ্ছেন। তার মেয়ে পিরিয়ডের এক বছর পূর্তিতে বন্ধুদেরকে খাইয়েছে। আপুর স্মার্ট মুভের জন্য আমাদের ছোট ভাগনিটা মানব সভ্যতা রক্ষায় নিজের অবধান রাখার প্রক্রিয়ার প্রথমধাপ অতিক্রম করায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছে। এটার কোন ফেসবুকে স্ট্যাটাস হয়নি!!

তৃতীয় ঘটনাটা আমার। আমার অক্ষরজ্ঞানহীন মায়ের সাথে আমি জগতের অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করি। অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও একজন মানুষ আধুনিক মানষিকতা ধারন করতে পারে তার প্রমান আমার মা। তার ধারাবাহিতায়ই আমার মায়ের সাথে আমার একদিন পিরিয়ড নিয়েও কথা হয়েছে এবং আমি ওঁনাকে বিষয়টাযে একেবারেই স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া সেইটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। একবার আমার ছোটবোনের পিরিয়ড সংক্রান্ত একটা জটিলতায় আমার মা আমার সাথে পরামর্শ করেছে। এইটারও কোন ফেসবুক স্ট্যাটাস হয় নি।

আরেকটা ঘটনা গেলো বন্যার। যেটার কথা শুরুতে লেখা হয়নি। তারপরও হুট করে মনে পড়ায় লিখছি। গেলো বন্যায় সবাই যখন তেল, চাল, ডাল নিয়ে বন্যাদুর্গত এলাকায় যাচ্ছিলো তখন একটা গ্রুপ সেখানে স্যানেটারি ন্যাপকিনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ত্রানের সাথে ন্যাপকিন ও গ্রামের মহিলাদের ন্যাপকিন ব্যবহার ও হাইজেনিক সচেতনতা তৈরির লক্ষে কয়েকটা মেয়ের একটা টিমও পাঠিয়ে দিয়েছে।

প্রথম তিনটা ঘটনা ও বন্যার ঘটনাটা আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক সুন্দর এবং আমার দেখা পিরিয়ড সংক্রান্ত বিপ্লবের অনলাইন ও অপলাইন মিলিয়ে সফল মুভম্যান্ট।

এবার আসি চতুর্থ ঘটনায়। মুলত এই ঘটনা ও এমন আরো সিমিলার কিছু ঘটনার জন্যই উপরের তিন চারটা স্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে এত লাইন লিখতে হইছে।

ঘটনাটা একজন গৃহবধুর। উনি দিনে মিনিমাম দশটা স্ট্যাটাস প্রসব করেন। তার স্ট্যাটাস আমার ভালো লাগতো। টুকটাক কমেন্টও করতাম। তেমনি একদিন সে স্ট্যাটাস দিয়ে জানালো সে রোজা রাখেনি পিরিয়ডের জন্য। কিন্তু সে লুকিয়ে খাওয়া দাওয়া করতে হচ্ছে। কারন কেউ দেখলে যদি তাকে জিজ্ঞেস করে কেনো রোজা রাখেনি তাহলে সে যে পিরিয়ডের জন্য রাখেনি এই কথাটা বলতে পারবে না। কেনো বলতে পারবে না, এইটার জন্য সে সমাজকে পঁচা বানিয়ে দিয়েছে, নষ্ট বানিয়ে দিয়েছে। কি সমাজে বাস করছে সেইটা নিয়া প্রশ্ন তুলছে।

কিন্তু আমি স্ট্যাটাসটা অনেকবার পড়ে তার স্ট্যাটাসটাকে রিয়ালাইজ করে সমাজের কোন দোষই খুঁজে পাইনি। যা দোষ খুঁজে পেয়েছি তা হলো তার পরিবার ও তার নিজের। সে ধুম করে কিছু লাইক আর বিশাল বিপ্লব করে ফেলবো আজ, এই আশায় স্ট্যাটাস না দিয়ে তার পরিবারকে পিরিয়ড সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারনা দিতে পারতো। পিরিয়িড যে একেবারেই একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া সেইটা বোঝাতে পারতো। এরপর যদি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়াটা জরুরি হয়ে থাকে তাহলে দিতে পারতো তার পরিবারকে চেঞ্জ করার উদাহরন সহ।

এরপর এই স্ট্যাটাস দেখে আরেকজন সাহসি হতো তার পরিবারকে এই বিষয়টা সম্পর্কে স্বাভাবিক করতে। কিন্তু জৈনক ভদ্রমহিলা এইটা না করে "স্যালুট আপা, এগিয়ে যান, সমাজটা আসলেই পঁচে যাচ্ছে" এই টাইপ কিছু কমেন্টের আশায় ফেসবুক একটা স্ট্যাটাস প্রসব করে দিয়েছেন অপলাইনে পরিবর্তনের চেষ্টা ছাড়াই।

এবং ফেসবুকে এই চতুর্থ ঘটনার সিমিলার মানুষজনই বেশি। কয়েকদিন আগে কিছু বিপ্লবি আবার রক্তমাখা প্যাড ফেসবুকে আপলোড দিয়ে প্রচুর সাহসি তকমা আর দুনিয়া উল্টাইয়া ফালানোর রেকর্ড গড়া শুরু করছিলো।

ওনারা হয়তো জানেনই না ওনাদের ফেসবুকের এই বিপ্লব ওনাদের কিছু অনুসারি ছাড়া আর বাইরে যাইতে পারে নাই। যেখানে মুলত বিপ্লবটা দরকার সেখানেই যাইতেই পারে নাই। কিন্তু প্রথম চারটা ঘটনার মানুষজন খুবই সহজ ও স্বাভাবিক ভাবেই বিপ্লবটা ছড়িয়ে দিতে পারছে এবং ফেসবুকের নীল সাদা আর লাইক কমেন্টের জোয়ারে ভেসে যাওয়া সাহসি পাবলিকদের থেকে ওইসব কম সাহসি আর সাধারন মানুষজনই বেশি সফল।

আসুন, জাতে উঠার জন্য ফেসবুকে গলা ফাটিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে বসে বসে লাইক না গুনে আর কমেন্টের রিপ্লে না দিয়ে একটু বাইরে আসি। ঠিক যেখানে দরকার সেখানে অল্প স্বরে কথা বলি, গলা না ফাটালেও চলবে। বিপ্লবটা অফলাইনে ছড়িয়ে দেই!!

আর/এস 

Leave a Comment