একাকী বাবার আশায় পথ চেয়ে থাকা!

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • মার্চ ২৮, ২০১৯

উঠোনের কোনে ডালিম গাছটার নীচে চেয়ার পেতে বসে আছেন তোজাম খাঁ। ডালিম গাছে অনেক দিন কোন ফুল আসেনা, ডালিমের ভরে গাছটা এখন আর নুইয়ে পড়েনা মাটিতে। এই গাছটার নীচে বসলেই কেমন যেন তার অতীত মনে পড়ে যায়, চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে চায়। গাছটা এখন আর আগের মতো তরতাজা নেই, কেমন যেন চুপসে গেছে! গাছটার নীচে অযত্নে, অবহেলায় জমা জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে তোজাম খাঁ'র মনে পড়ে গেল সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর কথা। সারাদিন যে এক করে সংসার সাজাতো, কখনো এতোটুকু ময়লা জমতে দেয়নি গাছটার গোড়ায়। কতো ভালোবাসা আর কতো যত্ন অথচ সন্তান সুখ দিতে গিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেল সে। তিন বছরের শিশু ছেলেটাকে, স্বামী আর সাজানো পরিবার ছেড়ে না বলেই চলে গেল! সেই থেকে ছোট্ট ছেলেটাকে মানুষ করার লড়াইয়ে নেমেছিলো তোজাম খাঁ, মায়ের অভাব কখনো বুঝতে দেয়নি ছেলেটাকে। মায়ের মতো স্নেহ, ভালোবাসা ; বাবার মতো শাসন আর আদরের মাঝেও হয়তো কখনো খামতি ছিল তা নিতান্তই মনের দোষে।

তোজাম খাঁ'র বয়স বাড়ছে, সাথে বাড়ছে অপ্রাপ্তির হিসাব আর মানুষের পালটানো রূপ দেখার অভিজ্ঞতাও। তোজাম খাঁ পেশায় ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর অথচ কখন যে নিজের ছেলেটাই অমানুষ হয়ে উঠেছে বুঝতেই পারেননি তা। তার হাতে কতশত অযোগ্য যোগ্যের মুকুট পড়েছে তার হিসেব নিজেই জানে না অথচ নিজের ছেলেটাই যে অযোগ্য রয়ে গেছে, এ হিসাব মিলাতে গিয়ে প্রতিনিয়তই চোখ ভেজায় তোজাম খাঁ। তোজাম খাঁ'র বয়স ষাট পেরিয়েছে, ছোট্ট ছেলেটার এখন ছোটখাটো সংসার হয়েছে তাই বৃদ্ধ বাবার খোঁজ রাখার সময় পায়না। ছেলেটাকে দেখার জন্য একবার শহরেও পাড়ি দিয়েছিলেন তোজাম খাঁ, কিন্তু তার অযাচিত চলে আসা যে ছেলে, ছেলের বউ ভালোভাবে নেয়নি, কথা আর চালচলনে তা স্পষ্ট পুরোটাই। 

বুঝতে পেরেই আবার পথ ধরেছেন সেই চেনা রাস্তায়। শহরে যাওয়ার পথে যেই মানুষটা ছিল প্রাণবন্ত, শহর থেকে ফেরার পথে সেই মানুষটাই রিক্ত, ব্যথা বেদনায় কুঁকড়ে যাওয়া এক মানুষ। নিজের আদর্শের গড়া ছেলেটা এমন অমানুষ হবে ভাবতেও পারেন নি কিন্তু স্কুল শেষে ঘেমে নেয়ে রান্না করে , রক্তজল করা পয়সায় মানুষ করা ছেলেটা আজ বাবাকে স্বীকার করতেও চায়না, ডাক্তার ছেলে ডাক্তার বউ, সোসাইটির বড়লোক শ্বশুর সেখানে সেই পাতি মাষ্টারকে মানায় না, ভাবতেই চোখ ভিজে যায় তোজাম খাঁর। আবার ফিরে আসেন সেই পুরনো ডালিম গাছটার তলায়। বৃদ্ধ বয়সে যেখানে সবার সাথে একসাথে থাকতে চেয়েছিলেন সেখানে আজ সবার থেকে আলাদা। বউয়ের স্মৃতিচারণ করেই বেঁচে আছেন সেই মানুষ গড়ার পাতি মাষ্টার তোজাম খাঁ। দু'চোখে আজও স্বপ্ন বোনেন ছেলে ফিরবে, দাদু ডাক শুনতে পারবে হয়তো মৃত্যুর পর তবুও সেই আশার পথ চেয়ে দিন কাটে তোজাম খাঁ'র। নিজের সমস্তটা বিলিয়ে দিয়ে এভাবেই নিঃশেষ হতে হবে বৃদ্ধ পিতার? সন্তানের সুখের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া কি তাহলে অপরাধ, পাপ! সন্তানের ভালো ভেবে কতো পাপ করে যায় পিতামাতা অথচ দিনশেষে একবুক অবহেলার পাহাড়ে জমে তারা।

Leave a Comment