ভাবি ঘরে এলেই ভাই পর হয়? নাকি পরিস্থিতি বিপরীত হয়!

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • অক্টোবর ১১, ২০২০

আজকাল প্রতিরাতেই তন্দ্রার নামে অভিসম্পাত করতে করতেই সকাল হয় ফুরাদের বউয়ের। মাঝরাতে ফুরাদ অফিস থেকে ফেরার পর বাঁধে লঙ্কাকাণ্ড। পাশের রুমে পড়ার টেবিলে কিংবা বিছানায় বসা তন্দ্রা স্পষ্টই শুনতে পায় সবটা। প্রতিরাতে এই অশান্তির কারনটাও যে সেই, এটা বোঝার ক্ষমতাও হয়েছে তন্দ্রার কিন্তু প্রতিকার করার কোন ব্যবস্থা জানা নেই।

ছোটবেলায় তন্দ্রার বাবা সংসারের নানা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই বলতো, "মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু, প্রতিনিয়ত সেই শত্রুতারই ফায়দা লুটে নেয় পুরুষরা। যতদিন না পর্যন্ত মেয়েরা নিজেদের সত্ত্বার প্রতিই হিংসা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, দোষারোপ, ক্ষোভ এসব মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসছে ততদিন এভাবেই পুরুষদের পায়ের তলায় গড়াগড়ি খাবে আত্নসম্মান! অসম্মানে কুঁকড়ে যাবে প্রতিনিয়ত অথচ একবার নিজের সত্ত্বাকে সম্মান জানাবে না। হোক সে শ্বাশুড়ি - বউমা, ননদ - ভাবি কিংবা বউ - ঝিয়ের সম্পর্ক।"

বাবার কোলজুড়ে বসে থাকা ছোট্ট তন্দ্রা সেদিন কথাগুলো না বুঝতে পারলেও আজ বুঝতে পারছে খুব স্পষ্টই।

বিকেলের আলো যখন একটু ফিকে হয়ে আসে সেই পড়ন্তবেলায় ফুরাদের সাথে আইসক্রিম আর জমজমাট আড্ডা দিতো তন্দ্রা। হঠাৎই সবকিছু কেমন রঙ হারালো, রঙ হারালো ভাই বোনের মিষ্টি সম্পর্কটাও। প্রায়ই পড়ন্তবেলায় সিঁড়ির পাশটায় সেই হারিয়ে যাওয়া সময়টার অপেক্ষা করে তন্দ্রা। হয়তো আবার সেইভাবেই ফিরে আসবে তার ভাই, হাতে আইসক্রিম আর বোনকে দেওয়ার মতো অফুরন্ত সময়। তন্দ্রার অপেক্ষা প্রতিনিয়তই রূপ নেয় না পাওয়ার যন্ত্রণায়। পড়ন্তবেলায় আইসক্রিম হাতে ফুরাদকে দেখে তন্দ্রা যেন ভুলে গিয়েছিল সবটা। 

আরো পড়ুনঃ গবেষণা বলছে, শৈশবে শাসন করা মায়ের সন্তানদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়!

- ভাইয়া আমার জন্য আইসক্রিম এনেছিস?

- না, মানে....

ফুরাদ আমতা আমতা করতে লাগল।

- আমি জানতাম তুই আনবি।

বলেই ফুরাদের হাত থেকে আইসক্রিম একরকম কেড়েই নেয় তন্দ্রা।

- আসলে ওটা তোর ভাবির জন্য.....

এক মুহূর্তের জন্য তন্দ্রা যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।

- ওহ, সরি। আমি তো ভুলেই গেছিলাম,আমার ঠাণ্ডা লেগেছে, আইসক্রিম খাওয়া বারন। তোর সাথে ফান করছিলাম, এই নে ধর... বুদ্ধু!...

ফুরাদের মুখে একটাও কথা নেই, কিইই বা বলবে সে! কি আছে বলার তার, তন্দ্রার ফেরানো আইসক্রিমটা নিয়ে রুমে চলে আসে। ফুরাদ জানে তার বউ সিঁড়ির ওপাশটায় ঘাপটি মেরে সবটা দেখছে। তন্দ্রার হাতে আইসক্রিম দেখলে শুধু যে ফুরাদের সাথে অশান্তি করবে তা না বরং তন্দ্রা আর মাকেও অশ্লীল ভাষায় অপমান করবে। ভাই হয়ে বোনের অপমান আর যাই হোক সহ্য করা যায় না কিন্তু কথায় কথায় বাচ্চার মাকে ঘরছাড়াও করা যায়না। যতো অশান্তিই হোক সন্তানের মুখ চেয়ে সবটা মেনে নিতে হয় আর সেই সুযোগটা পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাচ্ছে ফুরাদের বউ। ফুরাদ এও জানে, তন্দ্রা মিথ্যা বলছে যতো বড় ডাক্তারই ওকে বারন করুক না কেন ভাইয়ের থেকে আইসক্রিম না খেয়ে ও কিছুতেই ফেরাতে পারে না। ফুরাদ এখন ভোলে নি- হাজার মন খারাপ, বকুনি কিংবা বেদনার নীলচে রঙ যতই তন্দ্রাকে ঢেকে দিক না কেন তার ভাইয়ের হাতে আইসক্রিম বা চকলেট পেলে হাসির রেখা ফুটে উঠতো তার মুখে। ছোট্ট বোনটা যে ফুরাদকে ভীষণ রকম ভালোবাসে তা ফুরাদ খুব ভালোই জানে। চোখের সামনেই ছোট্ট বোনটা কত্তো বড় হয়ে গেছে, আজকাল আবার অভিনয় করতেও শিখে গেছে। ভাবতেই আশ্চর্য লাগে ফুরাদের।

- এই এনেছ, কি সব ভাবছো আনমনে!

- না কিছুনা, নাও।

বলেই বারান্দায় চলে যায় ফুরাদ, আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। বোনটার আনন্দ ধরে রাখার ক্ষমতাও নেই তার। কিই বা করতো সে! রোজকার এই অশান্তি তার আর ভালো লাগে না। তাই সে নিজেকে আর নিজের আদরের বোনটাকে ইচ্ছে করেই কষ্ট দেয়।

তন্দ্রা ভালো কোন কথা বললেও ফুরাদের বউয়ের কাছে তা নিম পাতার রসের মত তিতা লাগে সবসময়। কথায় কথায় তন্দ্রাকে কথা শোনায় ফুরাদের বউ, গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে অথচ এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয় সে, এই তার অপরাধ। তন্দ্রার ভাবি ভীষণ চিন্তিত ননদের বয়স হচ্ছে, যদি বিয়ে না হয় তাহলে তো ভাইয়ের ঘাড়ে বসেই খাবে আর ফুরাদের বউ হয়ে সে তা মেনে নেবে কেন! এই সংসারের জন্য সেও তো আর কম কষ্ট করছে না, এই সংসারটা এখন তারই। তাই সংসারের ভালো মন্দ দেখার দায়িত্বটা ও তার উপরই পড়ে। ফুরাদকে বারবার বলেছে বোনটাকে কারো ঘাঁড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিস্তার পেতে আর মা'টাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতেও বলেছে বারবার কিন্তু তন্দ্রার জন্য কিছুই করে উঠতে পারছে না সে। জীবনটাকে সাজাতে চায় সে, অনেক বড় হতে চায়। প্রতিষ্ঠিত হতে চায় অথচ ভাইয়ের কষ্টটা একবারো বোঝে না, কতটা স্বার্থপর হলে এমন হওয়া যায়... ভেবেই পায়না ফুরাদের বউ। দিনে রাতে হাজার বার অভিসম্পাত করে ননদকে। ফুরাদ কি বলবে বোনটাকে, আদরের বোনের স্বপ্নগুলো পূরণ করার দায়িত্ব নিয়েছিল সে অথচ কত কথা শুনতে হয় তার বোনটাকে।

চার বছর আগের কথা... 

আরো পড়ুনঃ সত্যিকারের ভালোবাসার ৭টি লক্ষণ জানুন!

ফুরাদ প্রথম চাকরি পেয়েছে, আনন্দে বোনটাকে জড়িয়ে সেদিন খুব কেঁদেছিল ফুরাদ কারন তার বাবা এই স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে ছিলেন যে ছেলে চাকরি করবে, অনেক বড় হবে কিন্তু যেদিন তার স্বপ্ন পূরণ হলো সেদিন তিনিই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। প্রতিদিন বোনের জন্য কিছু না কিছু আনতেই হতো তাকে। বোনের বায়নাগুলো ওর কাছে ভালোবাসার অন্য এক রঙের মতই লাগত।

- ভাইয়া.....

- হু...

- আইসক্রিম?

- কি?

- এনেছিস?

- কই না তো!...

- কি?

- কেন আনব শুনি?

- কেন আনবি না শুনি!...

- চাকরি পেলাম আমি, আমাকে না খাইয়ে তুই কি না আমার থেকে খেতে চাস! এটা কেমন অবিচার!

- মনে রাখিস কথাটা, আমি চাকরি পেলেও তোকে খাওয়াবো না কিন্তু!

- আহারে, আমার দুষ্টু বোনটার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে।

- আমায় নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই তো এখন চাকরি পেয়েছিস তোকে আর কে পায়!

- ইসসস, এই নে ধর! কি রাগ বাপরে বাপ। তোর বরের কপালে যে কি আছে কে জানে...

- ফুচকা........ তুই আমার বেস্ট ভাইয়া, তুই পৃথিবীর সেরা.....

- হয়েছে, হয়েছে, আর বাতাস দিতে হবে না ;ফেটে যাবে।

কি সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো অথচ আজ বোনের সাথে কথা বললেও অশান্তি পোহাতে হয় ফুরাদকে, সারাদিন অফিসের একগাদা কাজ করে আর অশান্তি কলহ ভালো লাগে না তার, তাই বোনের সাথে দূরত্ব বজায় রাখে আজকাল।

---

অথচ তন্দ্রা ভাইটাকে কি ভুলে থাকবে, সে যে ভীষণ ভালোবাসে, ভালোবাসে ওদের যত্নে লালিত রাগ, অভিমান আর দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া... অথচ সেই ভাই পালটে গেছে, তাকে দেখেও না দেখার ভান করে, বোন আইসক্রিম ভালোবাসে জেনেও বউয়ের জন্য আনা বলে ফেলে খুব সহজেই। গলাটাও ধরে আসে না, শুকিয়ে যায় না আজকাল। বিয়ের পর বোনের চেয়ে কি বউ বড় হয়ে যায়? নাকি বোনটাকে আজকাল বোঝা ভাবতে শুরু করেছে নিজেও। কেন এমন পরিবর্তন?.... বলতে বলতে কান্না জড়ানো মুখ লুকায় তন্দ্রা মায়ের বুকে। বাবা মারা যাবার পর এই আশ্রয়টাই তার একমাত্র সম্বল অথচ তাকেও বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর প্রয়াশ চলছে। মা কি বলবে ভেবে পায়না, তার কাছে কোন উত্তর নেই দেবার মতো। দীর্ঘশ্বাস সবার অজান্তেই মিশে যায় এই পৃথিবীর বুকে, না জানা উত্তর ঢেকে দেয় এক গভীর সম্পর্ককে।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment