জাপান ভ্রমণের স্মৃতি

  • ডাঃ মোঃ ফজলুল কবির পাভেল
  • ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৯

নভেম্বরের ২৯ তারিখে রাতের বেলায় হঠাৎ করেই ফেসবুকে মেসেজ পেলাম। ছোটবোন পাপলু জাপান যেতে বলছে। ও চলে যাবে আমেরিকায় সামনের মাসে। একমাস হাতে সময় আছে। জাপান সম্পর্কে ছোটবেলাতেই অনেক কিছু শুনেছিলাম । তারা ফুল খুব ভালবাসে এবং অসম্ভব শান্তিপ্রিয় জাতি। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সূর্য উঠে জাপানে। পাপলুর কাছ থেকে জাপান সম্পর্কে অনেক কিছু শুনতাম । ভাবতাম মনে হয় বেশী বলছে।পরে জাপান যেয়ে দেখলাম ওর থেকেও আমার জাপান পছন্দ হয়েছে। ১০ দিন ছিলাম জাপানে। ঘুরেছি অনেক জায়গায়।দেখেছি অনেক কিছু। যাই হোক মেসেজ পড়ে দেখলাম হাতে বেশী সময় নেই। যা করার ১৫ দিনের মধ্যেই করতে হবে। একটু টেনশনে পড়লাম । সবচেয়ে ঝামেলার বিষয় ছিল সরকারী অনুমতি। আল্লাহ্র রহমতে খুব দ্রুত পেয়ে গেলাম। পাপলু অনেক কাগজপত্র পাঠিয়েছিল । 

গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেসব। কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল পরে বলছি সেকথা। সব কাগজপত্র নিয়ে নাইট কোচে রওনা দিলাম। করের কাগজের জন্য একজন খুব সাহায্য করলেন। সেই ভদ্রলোকের কথা কখনই ভুলে যাবার নয়। সারারাত বাসে তেমন ঘুম হলোনা। খুব ভোরে ঢাকায় নামলাম। হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম না নিয়েই বের হলাম। একটু টেনশন হচ্ছিল। জাপান এম্বেসি সকাল ৯ টায় ভাইভা শুরু করে। সকাল ৯ টা মানে কিন্তু ৯ টা । ৮-৩০ বা ৯-৩০ নয়। আমি ৭-৩০ টার দিকেই পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি সেই ভোরে আরও ২ জন এসে হাজির। আমার সিরিয়াল হল ৩। আশেপাশে বসার জায়গাও নেই। একটু হাঁটাহাঁটি করে কোনরকম বসার জায়গা পেলাম। ৮-৩০ এর দিকে বেশ কিছু লোকের সমাগম হল । তাদের মধ্যে কেউ কেউ জাপানি ভাষায় কথা বলছিল। একটু হতাশই হলাম। 

ভাবলাম আমার জাপানি ভাষার দৌড় তো আরিগাতো গোজাইমাস(ধন্যবাদ) পর্যন্ত । আরেকটা শিখেছিলাম সেটা হচ্ছে দামে(not good)। ভাবছিলাম যদি ভিসা না পাই তবে প্রথমে দামে তারপর আরিগাতো গোজাইমাস বলে চলে আসব। ঠিক সকাল ৯ টায় ভাইভা শুরু হল । আমার সিরিয়াল হয়ে গেল ৫। কিভাবে ৩ থেকে ৫ হল সেটা রহস্যই থেকে গেল। সবাইকে একটা মাঝারি রুমে বসান হল। ভাইভা যারা নিচ্ছেন তাদের দেখা যাচ্ছেনা কিন্তু তারা আমাদের দেখতে পাচ্ছেন। বিভিন্ন কর্নারে স্পীকার আছে। সেখান থেকে আঁটসাঁট গলায় বিভিন্ন নাম আর নম্বর ভেসে আসছে। কাগজপত্র আর অনানুষ্ঠানিক ভাইভার পর বসতে বলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাইভার ফলাফল জানা যাচ্ছে । আমার নাম ডাকতেই ছোট এক রুমে গেলাম। সেখানেও একই অবস্থা। আমি কাউকে দেখেত পাচ্ছিনা সেখানেও স্পীকার থেকে নির্দেশ এল সব কাগজপত্র বের করতে। কাঁচের একদিকে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা ছিল সেদিক থেকে ডকুমেন্টস দিলাম । কাগজপত্র সব গোছান ছিলনা। যিনি নিচ্ছিলেন তাকে একটু রাগী মনে হল। মনে হল আমি সহ তিনি সমগ্র মানবজাতির উপর কিছুটা বিরক্ত। 

একবার তো বলেই বসলেন ,”আপনি জাপান যাবেন কোন কিছুই গোছান নাই কেন? “ আমি বললাম ,” সারারাত জার্নি করে এসেছি তাই গোছাতে পারিনি ।“ ভদ্রমহিলা বললেন ,”জাপান যাবেন এটা তো নিশ্চয় একদিনের পরিকল্পনা নয়।“ চুপ করে থাকলাম। তবে সব কাগজপত্র দেখে কিছুক্ষণ পরেই আবার ভাল ব্যবহার শুরু করলেন। পাপলুর পাঠান সব কাগজ দেখার পর থেকেই সুর নরম হয়ে গেল। কোন বাড়তি কাগজ চাইলেন না। তারপর বাইরে বসতে বললেন। বাইরে এসে দুই একজনের সাথে আলাপ জমালাম। আমার সামনের প্রথম ৪ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন ভিসা পেলেন। বাকিদের আরও কাগজপত্র নিয়ে পরে দেখা করতে বলা হল । আমার নাম ডাকল।কাঁচ দিয়ে ঘেরা সেই রহস্যময় জায়গায় গেলাম। ভেতর থেকে একজন বললেন ১৬ তারিখ এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেতে । ভিসা দিলে পাসপোর্ট রেখে দেয় সেটা জানতাম। আর না দিলে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে আবার দেখা করতে বলে। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ভাইভাতে ঢোকার আগে পাপলুর ফোন। আবার বের হবার সাথে সাথে ফোন করল। টেলিপ্যথি বোধ হয়। সব শুনে বলল ,”আর চিন্তা নাই এবার এয়ারলাইন্সে খোঁজ নে ।“ অনেক আনন্দ নিয়ে তারপর রাজশাহীর পথে উড়াল দিলাম......

রাজশাহীতে ফিরলাম নভেম্বরের ৯ তারিখে। প্রত্যেকটা দিন গেছে চরম উত্তেজনায়। ভয় হচ্ছিল যদি ভিসা না দেয়। কারণ আমি শুনেছিলাম অনেক সময় পাসপোর্ট রেখে দিলেও ভিসা দেয়না। এর মধ্যেই এক দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললাম। ভিসা নিশ্চিত হবার আগেই টিকিট কেটে ফেললাম। আমার চাচাত ভাইয়ের ট্র্যাভেল এজেন্সি আছে। খুব বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য মানুষ । প্রথমে মালয়শিয়ান এয়ারলাইন্সে বুকিং দিলাম। ৭৩ হাজার টাকা লাগল । জাপান যেতে প্রায় ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। মালয়শিয়ান এয়ারলাইন্স একবারই থামে। ৪ ঘণ্টা লাগে মালয়শিয়ায় যেতে । সেখান থেকে জাপান যেতে লাগে ৭ ঘণ্টার মতো। মালয়শিয়ায় ৪-৫ ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। ১৬ ই নভেম্বর বুকিং ছিল। পরে দেখলাম ক্যথে প্যসিফিকেও জাপানে সহজে যাওয়া যায় । ভাড়াও কিছুটা কম। 

একবারই থামে হংকং এয়ারপোর্টে ।পাপলুর আমেরিকা যাওয়ার তারিখ ছিল ডিসেম্বরের ১ তারিখ। আর আমার ভিসার পাবার ডেট ছিল নভেম্বরের ১৬ তারিখ। সময় না মেলার কারণে শেষ পর্যন্ত চায়না ইস্টার্ন এয়ারে টিকিট কেটে ফেললাম। আরেকটা কারণ ছিল অবশ্য । অনেক সস্তায় টিকিট পাওয়া গেল! যারা একা ট্র্যাভেল করবে তাদের জন্য এ প্লেন ভাল। তবে পরিবার থাকলে চায়না ইস্টার্নে না যাওয়াই ভাল। তাদের সার্ভিস অনেক ভাল। কিন্তু এত জায়গায় প্লেন থামে! প্রথমে প্লেন থামল কুন মিং । তারপর সেখান থেকে প্লেন পরিবর্তন করে বেইজিং এ। সেখান থেকে আরেক প্লেনে সাংহাই । সাংহাই থেকে আরেক প্লেনে জাপানের নারিতায়। বারবার প্লেন পরিবর্তন করতে অস্থি ,তরুণাস্থি এবং মাংসপেশির অনেক কষ্ট হয়েছে। যাই হোক রাজশাহীতে বসেই টিকিট হাতে পেলাম। ১৯ তারিখ দুপুর ২-৪৫ এ ভ্রমণ শুরু হবে। 

পৌঁছাব (যদি সব ঠিক থাকে) পরদিন বিকেল ৪-৫৫ তে। ভিসা আনতে আমি নিজে যাইনি । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আমার পাসপোর্ট ভিসা এনে দিয়েছিলেন । তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ । অত্যন্ত ভাল সজ্জন একজন মানুষ তিনি । ১৬ তারিখ রাত ১০ টার দিকে পাসপোর্ট হাতে পেলাম। ১৭ তারিখ ব্যপক উত্তেজনায় কাটালাম । আনিশাকে নিয়ে সারাদিন ছিলাম। খুব মায়া হচ্ছিল মেয়েটার জন্য ।।পৃথিবীটা আসলে মায়ারই এক জায়গা। একবার মায়া পড়ে গেলে বাড়তেই থাকে। ১০ দিন দেখতে পাবোনা । তার ফুপি এবং ভাই যে জাপানে থাকে তা সে জানে। বাড়ির উপর দিয়ে প্লেন গেলেই বলে ফুপি আসছে। ফাইজান আসছে। পাপলুর ছেলের নাম ফাইজান। আম্মা তিনবার জাপানে গিয়েছিল। বিভিন্ন উপদেশ দিল । বেশকিছু জাপানি টাকাও দিল। পরে অবশ্য সে টাকা দিয়ে অনেক উপকারও হয়েছে। কিন্তু আম্মা চাচ্ছিল রাজশাহীর যত খাদ্যদ্রব্য সব লাগেজে দিতে। মায়ের মন সব সময় মনে হয় সন্তানের জন্য চিন্তা করে। আমি কিছুটা আপত্তি করলাম।

 বিশেষ করে মিষ্টান্ন জাতীয় দ্রব্যাদি নিতে আমার ঘোরতর আপত্তি ছিল। রুবেলও পাপলুর জন্য মিষ্টি কিনে দিল। লাগেজে প্রায় তিন কেজির মতো মিষ্টি । তার মধ্যে রসকদম গুলোকে রীতিমত ছোটখাট বোমার মতো লাগছিল। ভাবলাম এয়ারপোর্টে নিশ্চয় একটা দ্বান্দিক অবস্থান তৈরি হবে। রাতের বেলায় রুবেলের কাছে গেলাম। রুবেল আমার বড় ভাই।  ও জাপান থেকে পিএইচডি করেছে। বছর তিনেকের বেশী জাপানে ছিল। অনেক গল্প শুনলাম । কোথায় কোথায় যাব তার একটা লিস্ট বানিয়ে ফেললাম। কিছু চৈনিক মুদ্রাও দিল রুবেল। চীনে সেই মুদ্রাগুলো খুব কাজে দিয়েছিল। চীনে একরাত ছিলাম। পরদিন সকাল ১১ টায় ঢাকায় রওনা দিলাম। শুক্রবার ছিল সেদিন। ফুড ভিলেজে নামাজ পড়ে নিলাম। বিকেল ৫ টার দিকে ঢাকায় পৌঁছালাম । তারপর সিএনজি নিয়ে সরাসরি এয়ারপোর্টের উল্টাদিকে হাজী ক্যম্পের পাশে এক হোটেলে গিয়ে উঠলাম ।পাঁচ তলায় রুম পেলাম। মান মোটামুটি । যদিও নিন্দুকেরা এটা লিল্লাহ বোর্ডিং বলবে। যাই হোক জানালা খুলতেই মন ভাল হয়ে গেল। 

একটু পরপর প্লেনের উঠানামা দেখতে থাকলাম। প্লেনের উঠানামা দেখতে অন্যদের কেমন লাগে জানিনা আমার খুব ভাল লাগে। একটু পর খেতে নামলাম । খাবারের মান মোটামুটি । নান রুটি আর গ্রিল খেলাম। তারপর হাঁটতে বের হলাম। একটা মানি এক্সচেঞ্জ চোখে পড়ল । টাকা দিয়ে কিছু ডলার কিনলাম। তবে তাদের মুখভঙ্গি দেখে মনে হল আমাকে কিছুটা ঠকাতে পেরেছে। তাদের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি দেখলাম। অন্যকে ঠকিয়ে যে কিছু মানুষ আনন্দ পায় সেটা আবার দেখে ফেললাম। তারপর আরও কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে রুমে ফিরে এলাম। ঘুম আসছিল না। কেমন জানি চাপা উত্তেজনা বোধ করছিলাম। ফোনে পরিচিত অনেকের সাথে কথা বললাম। কখন যে ঘুমিয়ে গেছি টেরই পায়নি। নাহারিন মন খারাপ করছিল। প্রতিজ্ঞা করলাম ফিরেই কক্সবাজার নিয়ে যাব (যদিও এখনও যাওয়া হয়নি )। সকালে উঠে নাস্তা করলাম। রুটি আর সব্জি ডাল । সামান্য আয়োজন । তারপর রুমে এসে সব গুছিয়ে সিএনজি ডাকতে গেলাম। এয়ারপোর্ট দেখা যাচ্ছিল । 

তারপরও ১৩০ টাকা নিল। কি আর করা ।দিলাম। এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম ১১ টার দিকে। গিয়ে দেখি তখনও বোর্ডিং পাস দেয়া শুরু করেনি। বসে থাকলাম। কাকতালীয় ভাবে এক আত্মীয়ের সাথে দেখা। তিনি এয়ারপোর্টেই চাকুরি করেন। একটু স্বস্তি পেলাম। একটু পর দেখি বোর্ডিং পাস দিচ্ছে। লাইনে দাঁড়ালাম । ভেবেছিলাম অনেক বাঙালির দেখা পাব। হতাশ হলাম। ৫-৬ জনের বেশী চোখে পড়ল না। বোর্ডিং পাস পাবার পর ইমিগ্রেশনে চলে গেলাম। লাইন বড় ছিলনা। তাছাড়া অফিসিয়াল পাসপোর্ট বলে কিছুটা সুবিধা পেলাম। ২ মিনিটেই সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হল। তারপর একটু হাঁপ ছেড়ে বসলাম । দুই একজন বাঙালির সাথে পরিচিত হলাম। একজন আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। 

পাপলু এর মধ্যেই দুইবার ফোন দিল । ভাই এর প্রতি বোনের এই যে ভালবাসা এর কোন তুলনাই হয়না। শুভ ফোন দিল। এত ভাল ছেলে যে এই দুনিয়ায় এখনও আছে ভাবলে আরও অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছে করে।তারপর শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। এই সময় আত্মীয় মিনহাজ ভাই এলেন। একসাথে বসে চা নাস্তা খেলাম। তারপর তিনি সাথে নিয়ে একেবারে প্লেনের দরজার কাছে নিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে প্লেনে গিয়ে বসলাম । প্লেনটা ছিল বেশ ক্ষুদ্রাকৃতির । ছোট প্লেন আমার ভয় লাগে। মেঘের সাথে যখন বাড়ি খায় তখন কাঁপতে থাকে। পাশে বসল দুইজন চীনা নাগরিক। মজার ব্যপার কেউ ইংরাজি জানেনা। ভাবলাম ২ ঘণ্টা একা একা নীরবেই বসে থাকতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে দেখি পাইলট উপরে উঠার ঘোষণা দিচ্ছে। স্রষ্টাকে স্মরণ করতে করতে কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম ঘরবাড়ি খুব ছোট দেখাচ্ছে। মিনিট পাঁচেক পর মেঘ আর নীলাকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না..

প্লেনে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকলাম। শেখ সাদি বলেছিলেন,” ভ্রমণের সঙ্গী যদি ভাল হয় তাহলে ভ্রমণ আনন্দজনক হয়” ।আমি তো ভ্রমণ করছি একা। সুতরাং আনন্দজনক হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। কিছুক্ষণ পর খাবার দিয়ে গেল। তেল ঝাল নুন বিহীন খাবার। তবে খিদে লেগেছিল অনেক । তৃপ্তি করেই খেলাম। আমার বোর্ডিং পাসে লেখা ছিল প্লেন ঢাকা থেকে বেইজিং যাবে। কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম প্লেন যাবে কুনমিং এ। ভয় পেয়ে গেলাম। এ ব্যপারটা নিয়ে আমার দ্বিধা ছিল। বিমান সেবিকাদের জিজ্ঞাসা করলাম। 

তারা যে কি বলল কিছুই বুঝলাম না। তবে তাদেরকে খুব আন্তরিক মনে হল! মনের ভেতর খচখচ করতে লাগল। তবে ঘণ্টা দেড়েক পর যখন ঘোষণা এল যারা বেইজিং যাবে তাদের জন্য বিমানের একজন প্রতিনিধি কুনমিং এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করবে। তার সাথে যেয়ে অন্য একটি বিমানে উঠতে হবে। কিছুক্ষণ পর দেখি বোর্ডিং পাস খুজে পাচ্ছিনা। আচ্ছা ঝামেলায় পড়লাম । বোর্ডিং পাস হারালে বেশ বিপদ হয়। মনেপ্রাণে স্রষ্টাকে ডাকতে থাকলাম। অল্প কিছুক্ষণ পর কুনমিং এয়ারপোর্টে প্লেন  ল্যান্ড করল। মাথার উপর ছোট লাগেজ ছিল। খুলতেই বোর্ডিং পাস পেয়ে গেলাম! মনের সাহস ফিরে পেলাম। প্লেন থেকে নেমে ভিতরে ঢুকতেই দেখি দুইজন বেইজিং বেইজিং করছে। কাছে যেতেই আমার বোর্ডিং পাস নিয়ে অন্য একটা বোর্ডিং পাস দিল। সেখানে প্লেনের আরেক বাঙালি সহযাত্রী পেয়ে গেলাম। তিনিও বেইজিং যাবেন । 

উনার নাম নুরুল। সিলেটের মানুষ । চীনে ব্যবসা করেন। যাই হোক আমরা ইমিগ্রেশনে চলে গেলাম। কোন ঝামেলা হলোনা । দ্রুত কাজ সমাধা হল। তারপর হাঁটতে থাকলাম। পথ যেন শেষই হয়না। সাথে নুরুল ভাই সহ আরও ৪ জন বাঙালি পেলাম যারা বেইজিং যাবেন। এবার একটু ভাল লাগল । একজোট হয়ে গেলাম। বেইজিং এর প্লেন যেখান থেকে ছাড়বে তার আগে চেকিং হল। ভয়াবহ চেকিং। খুব কড়াকড়ি । তারপর গেটে চলে গেলাম। দেখি অনেক ভিড় । দুইজন বাঙালি অফিসারকে দেখলাম। তবে তাদের আচরণ কেমন জানি সন্দেহজনক । ভাষাও সংযত নয়। তারপর বাসে করে এয়ারপোর্টের ভেতরের দিকে গেলাম। সেখানে প্লেন দাড় করান ছিল। উঠে বসলাম । এবার পাশে যে দুজন চীনা নাগরিক বসল তারা আরও বেশী ইংরাজি পারেনা। আচ্ছাই বিপদ হল । একজন মা দেখি সন্তানের জন্য বস্তায় ভরে অনেক কিছু নিয়ে যাচ্ছে । 

সম্ভবত বস্তা অনেক ভারী । তুলতে কষ্ট হচ্ছিল। বিমান সেবিকারা সাহায্য করল। তবে তারা হাসাহাসি করছিল। আসলে পৃথিবীতে সব মা বোধহয় একইরকম । হোক তা চীন বা চিলি। এবার যে খাবার দিল দেখে হাসপাতালের ডায়েট ২ চার্টের কথা মনে পড়ে গেল। জাউ ভাত এবং চিকেন। দুর্ধর্ষ স্বাদ । আমি যেহেতু রোগী না সুতরাং গলা দিয়ে নামছিল না। তবে আশেপাশের লোকজনকে দেখলাম দিব্যি টেনে যাচ্ছেন । অনেকের সুখে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ! কোনরকম  জ্যুস  খেয়েই ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে দিলাম। ভাবলাম বেইজিং এ যেয়ে ডিনার করব। কিছুক্ষণ পর প্লেন নামার ঘোষণা দিল। তবে বলল বেইজিং এর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুনেই ঠাণ্ডা লাগা শুরু হল। এতক্ষণ ভালই ছিলাম! প্লেন থেকে নামতেই বেইজিং এর ঠাণ্ডা আমাদের স্বাগত জানাল। আমাদের সাংহাই এর ফ্লাইট ছিল পরদিন সকাল ৮ টায় । বেইজিং এ পৌঁছালাম রাত ১২ টার দিকে। 

বাজেট এয়ার বলে তারা হোটেলের ব্যবস্থা রাখেনি। আমিও  বুকিং দিয়ে যাইনি । তাই দেখলাম সারা রাত এয়ারপোর্টে বসেই কাটাতে হবে। উপায় নাই গোলাম হোসেন ! আমরা একটু বসার জন্য এদিক ওদিক ঘুরতে থাকলাম। কিন্তু কোথাও বসার একটু জায়গা পেলাম না। একটা হোটেল পেলাম। কিন্তু সেখানে বসতে হলে খেতে হবে। ৭৫ ইউয়ান খরচ হবে। ১ ইউয়ান মানে প্রায় ১৩ টাকা ।সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হলোনা । চীনা খাবার খেয়ে ৭৫ ইউয়ান খরচ করতে ইচ্ছে হলোনা একটু বসার জন্য আবার বের হলাম। পেলাম না। হালাল খাবারও কোথাও খুঁজে পেলাম না। অবশেষে আমি আর নুরুল ভাই মেঝেতেই বসে পড়লাম ! এই সময় রুবেলের চৈনিক মুদ্রা কাজে এল। পানীয় কিনে খেলাম। পানীয় বলতে যারা অন্য কিছু বুঝছেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলি সেটা ছিল নিরীহ ধরণের চা জাতীয় পানীয় । 

অন্য কিছু নয়! খাওয়ার পর কিছুটা চাঙ্গা হলাম। ফেসবুকে ঢুকতে পারছিলাম না। সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন । wifi থাকার কথা। আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট । কিন্তু পেলাম না। তবে বেইজিং এ নামার পরপরই এক বাঙালি ভদ্রলোকের মোবাইল থেকে বাসায় ফোন দিয়েছিলাম। অবশ্য পাপলুর সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। এরপর শুরু হল নুরুল ভাইয়ের সাথে গল্প। সারারাত গল্পে গল্পে কেটে গেল। একফোঁটাও ঘুম হয়নি। খুব ক্লান্ত বিধ্বস্ত লাগছিল।ভোর ৬ টার দিকে বোর্ডিং পাস নেবার জন্য গেলাম। আমি যাব নারিতা জাপানে। নুরুল ভাই সাংহাইতে । নুরুল ভাই চীনে ৮-১০ বার এসেছেন। উনার সবকিছু নখদর্পণে । তাড়াতাড়ি বোর্ডিং পাস পেলাম। কিন্তু আমাকে সুযোগ দেয়া হল আমি আমার লাগেজ সরাসরি নারিতায় নিতে পারব। সাংহাইতে নিতে হবেনা। তবে অন্য কাউনটারে যেতে হবে। 

গিয়ে বললাম সেইখানে। কিন্তু কাউনটারে বসা ভদ্রমহিলা লাইনে দাঁড়াতে বলল । আমার বিব্রত অবস্থা দেখে বেশ কয়েকজন দেখলাম মজা লুটে নিল। অন্যের অপমান দেখার নেশা বড় নেশা। যাই হোক দীর্ঘ লাইন। অবশেষে বোর্ডিং পাস পেলাম আবার। সেখান থেকে চেকিং শেষে গেটে গিয়ে বসলাম । তারপর আবার বাসে করে এয়ারপোর্টের ভেতরে নিয়ে গেল। বেইজিং এর তাপমাত্রা ছিল সেদিন ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাস থেকে নেমে প্লেনে উঠতেই ঠাণ্ডায় কেঁপে উঠলাম । তবে এবার মনটা ভাল হয়ে গেল প্লেনের সাইজ দেখে। বিশাল বড় । এইধরনের প্লেনে উঠার শখ বহুদিন ছিল। তবে সন্দেহ হল এত বড় প্লেন উঠতে পারবে তো ? কিছুক্ষণ পর শঙ্কা কেটে গেল। নিজেকে ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে প্লেনের ভেতর আবিষ্কার করলাম। পাশে বসেছিল এক চীনা ইঞ্জিনিয়ার। ভাল ইংরাজি বলতে পারেন। হাসিখুসি টাইপের । অনেক গল্প হল। আগেরদিন সেই পানীয় ছাড়া কিছুই খাইনি। ঘুম আসছিল। ঘুমিয়ে পড়লাম । কিছুক্ষণ পর ক্ষুধায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম সবার খাওয়া শেষ । 

বিমানসেবিকাদের বলাতে নাস্তা এনে দিল। এত স্বাদ! যে খেতেই পারলাম না। ঘণ্টা তিনেক পর সাংহাই তে পৌঁছালাম। সেখানে নামার পর দেখি ইমিগ্রেশনে বিশাল লাইন। অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর আমার পালা এল। গেলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার খুবই সন্দিগ্ধ চোখে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন । উত্তর দিলাম। সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। পরে আরেকজনকে ডাকলেন । তিনি আসার সাথে সাথে কাজ হয়ে গেল। তারপর আবার চেকিং শেষে গেটে এসে বসলাম । নুরুল ভাইয়ের থেকে বিদায় নেওয়াও হলোনা । তবে বাংলাদেশে আসার পর তিনি একবার ফোন করেছিলেন। আমাকে ভোলেননি । যেখানে বসে ছিলাম সেখানে এক চীনা আর একজন আমেরিকান ভদ্রলোক ছিলেন। তারাও জাপান যাচ্ছেন। ইন্টারনেটের সংযোগ পাচ্ছিলাম না। পাপলুকে কিছুই জানাতে পারছিলাম না। নিশ্চয় টেনশন করছে !যাই হোক অনেক ভাল লাগছিল। ভাবলাম তাহলে ইনশাআল্লাহ্ জাপান পৌঁছাতে পারব। তারপর প্লেনে উঠার আহবান জানাল। উঠে বসলাম। ততক্ষণে প্রায় ২১ ঘণ্টা কেটে গেছে প্লেনে উঠার পর থেকে। প্লেন যখন উপরে উঠল তখন এত ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বিধ্বস্ত ছিলাম ঘুমিয়ে গেলাম। তবে তৃপ্তি নিয়েই ঘুমিয়েছিলাম। ভাবলাম আর মাত্র ৪ ঘণ্টা পরেই প্রিয় মানুষগুলোকে দেখতে পাব......

কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই। যখন উঠলাম তখন দেখলাম জাপান পৌঁছাতে আরও ঘণ্টা খানেক সময় লাগবে। মনের ভেতর এক অদ্ভুত ভাললাগার অনুভূতি কাজ করছিল। এত কষ্টের অবসান হতে চলছে। প্লেনের খাবার ভাল লাগেনি। তবে একধরণের বিস্কিট দিয়েছিল যা ছিল খুব সুস্বাদু । জ্যুস খেতে খেতে অস্থির হয়ে গেলাম। আরও কিছুক্ষণ চলার পর প্লেন নিচে নামতে শুরু করল। জাপানের ভূখণ্ড দেখতে পেলাম। তখন বিকেল ৪ টার মতো বাজে। অল্প কিছুক্ষণ পর প্লেন নারিতা বিমানবন্দরে নামল । খুব বেশী ভাল লাগছিল সবকিছু। নামার পর ইমিগ্রেশনে চলে গেলাম। ব্যবহার খুব ভাল। এক মিনিটের মধ্যেই কাজ হয়ে গেল। তবে ফাইনাল চেকিং বাকী ছিল। আমার ভয় ছিল লাগেজের ভেতর বোমা সদৃশ রসকদম নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি হবে। আশংকা সত্যে পরিণত হল। কাস্টমস অফিসার খুব বিগলিত ভাবে লাগেজ খুলতে বলল । খুললাম। রসকদমের প্যকেটের দিকেই তার দৃষ্টি গেল প্রথমে। জহুরী মাণিক চেনে! ... চেনে কচু।  জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চাইল সেগুলো কি । 

বললাম সুইটমিট।উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হল। আমার বোন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করছে জেনে তাদের ব্যবহার মধুর মতো হয়ে গেল। লাগেজ খোলার জন্য সরি চাইল।আরিগাতও গোজাইমাস বলে প্রস্থান পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। নিশ্চিত ছিলাম কেউ না কেউ আসবেই। জাপান যদি ভূমিকম্পে ব্যপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তারা বেঁচে থাকে তবেও  তারা এয়ারপোর্টে আসবে। যদিও বাসা থেকে যাওয়ার সময় আব্বা আম্মা কিভাবে পাপলুর বাসায় পৌঁছাতে হবে তার বিস্তারিত বলে দিয়েছিল । আমি আর্সেনিক নিয়ে যে স্যারের সাথে কাজ করি তিনিও জাপান থেকে পিএইচডি করেছেন। আমাকে যাওয়ার আগ দিয়ে বললেন জাপানে অন্ধও পথ চলতে পারে। এত সুন্দর তাদের ব্যবস্থা। প্রস্থান দিয়ে বের হতেই দেখি শুভর হাসিমাখা মুখ। মনটাই ভাল হয়ে গেল। দীর্ঘ কোলাকুলির পর ট্রেনে চেপে বসলাম। এয়ারপোর্ট থেকেই ট্রেন ছাড়ে । 

জাপানি ভাষায় দেনসা। শুভ আবার টার্কিশ কেবাব নিয়ে এসেছিল। কেবাব মানে অন্য কিছু নয় কাবাব টাইপের জিনিস । শুধু নামটার কিঞ্চিৎ পার্থক্য । পাপলু আসতে পারেনি কারণ ফাইজানের জ্বর ছিল। আরও কেন আসতে পারেনি পরে বলছি সেকথা। টার্কিশ কেবাব অসাধারণ লাগল । আমার ভাসায় অসাম। একটা খেতেই পেট ভরে গেল। শুভ ২ টা এনেছিল। যে ট্রেনটাতে যাচ্ছিলাম সেটা শিনকানসেনএর ছোট ভাই। প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৩০ কিমি চলে। তবে ভেতর থেকে সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। কোন ঝাঁকুনি নেই। আমরা নিপ্পরি বলে একটা জায়গাতে এসে ট্রেন পালটালাম । কি অসাধারণ ব্যবস্থা। জাপানের ট্রেন সিস্টেম দেখে প্রথম দিনেই মন ভাল হয়ে গেল যা আজ পর্যন্ত থেকে গেছে। পরের ষ্টেশনে এসে দেখি শুভর মানিব্যগ হাওয়া। দুজনেরই মন খুব খারাপ হয়ে গেল। টাকার জন্য নয়। 

সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ছিল। তারা আমেরিকায় চলে যাবে। অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। শুভ সহজে বিচলিত হয়না। এবার একটু বিচলিত মনে হল। আমারও মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কি আর করা। সব ষ্টেশন এ যেয়ে তো আর খোঁজা যাবেনা । কমপ্লেন করে মন খারাপ করে দুইজন এসে যতদূর মনে পড়ে হিগাশি জুজও ষ্টেশনে এসে নামলাম। সেখানে থেকে পাপলুর বাসা হাঁটা দূরত্ব । ১০ মিনিটের মতো লাগে। নেমে হাঁটা ধরলাম। রাত হয়ে গিয়েছিল। মুগ্ধতা শুরু হল। কোন হৈচৈ নেই। রাস্তাঘাট পরিষ্কার । সবকিছু সাজান গোছান । অনেককে সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখলাম। কিছুক্ষণ পর পাপলুর বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম । ৭ তলায় বাসা। ২৩ কেজি ওজনের লাগেজ শুভ একাই টেনে আনল। এই ধরণের ছেলেকে কি না ভালবেসে পারা যায় ? লিফট দিয়ে ৭ তলায় উঠলাম । 

দরজা খুলেই দেখলাম পাপলু দাঁড়িয়ে । ভিনদেশে ভাইবোন দেখা হলে কেমন লাগে যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা জানে। যাদের নেই তারা কোনদিন বুঝবেনা। সুতরাং সে বিষয়ে বিস্তারিত বললাম না। ভাই আসবে জেনে পাপলু অনেক কিছু রান্না করেছে সারাদিন ধরে। কেকও বানিয়েছিল। অনেক পরিশ্রম করেছে সারাদিন। টেবিলে খেতে বসে তো চক্ষু চড়কগাছ । আমি চিংড়ি খুব পছন্দ করি। পাপলু সেটা জানে। এত বড় চিংড়ি আমি কখনও খাইনি। স্যমন মাছও খেলাম। টুনার কাবাব ছিল। মাংসও ছিল। সবশেষে একটা নাম না জানা ফল খেলাম এবং সেই ফলের ভক্ত হয়ে গেলাম। এদিকে যখন খেতে বসেছি তখন শুভর মোবাইলে একটা কল এল। শুভ জাপানি ভাষায় কি কি সব বলল একবর্ণও বুঝতে পারলাম না। ও অনর্গল জাপানী বলতে পারে। তারপর বলল মানিব্যগ পাওয়া গেছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। এ ধরণের ঘটনা অনেক শুনেছি । কিন্তু এবার নিজের সামনেই সব ঘটল । আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। শুভ মানিব্যগ আনার জন্য চলে গেল। ভাই বোনের আড্ডা যেন শেষই হয়না। ক্লান্তি সব কোথায় গেল কে জানে। কিছুক্ষণ পরে শুভ আসার পর আরেকপ্রস্থ আড্ডা । কোথায় কোথায় যাব পাপলু দেখি সব প্ল্যন করে রেখেছে।তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম । আগামীকাল ওদায়বা শহর দিয়ে আমার জাপান ভ্রমণ শুরু হবে। ততক্ষণ শুভরাত্রি .........

ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেল। বাইরে ছিল খুব ঠাণ্ডা । কিন্তু ঘরের মধ্যে বোঝার উপায় নেই। সকালে নাস্তা করলাম। রুটি , ডিম , মাংস, মিষ্টি, পুডিং ,কেক,ফল আর এক কাপ লাল চা। পাপলুই কষ্ট করে বানিয়েছিল।শুভ সাহায্য করল।আমি সাহায্য করতে চাইলাম নিলনা। শুভ ফাইজান কে নিয়ে হোকুইন চলে গেল। ফাইজান এর সাথে প্রায় ৫ মাস পর দেখা। মামাদের সাথে মনে হয় ভাগ্নেদের একটা আলাদা সুন্দর সম্পর্ক থাকে। ফাইজান ও মামাকে পছন্দ করে ফেলল ।হোকুইন যাবার সময় খুব মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল । এত মিষ্টি হয়েছে দেখতে! আমি আর পাপলু বের হলাম । মিনিট পাঁচেক হাঁটলাম । ষ্টেশনে যেয়ে ট্রেনে উঠলাম । একটা জায়গায় যেয়ে পাপলু দ্রুত নেমে গেল ।আমি নামতে যেয়েই দেখি ট্রেনের গেট দ্রুত বন্ধ হয়ে গেল। আমি বুঝতেই পারিনি এত দ্রুত গেট স্বয়ংক্রিয় ভাবে বন্ধ হতে পারে। বন্ধ হওয়ার সময় শুধু পাপলুর উদ্বিগ্ন মুখ আর একটা আওয়াজ পেলাম ,ভাইয়া পরের ষ্টেশন । ট্রেন ছেড়ে দিল। বুকের মধ্যে ধক করে উঠল । জাপানে সিম কেনা একটু ঝামেলার। মোবাইল আছে কিন্তু সেটা ছবি তোলা ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবেনা । 

পকেটে ইয়েন নেই, ডলার আছে। কিন্তু ট্রেনের টিকিট কাটতে ইয়েন লাগবে।নামার পর কি হবে ভাবতে একটু ভয় পেয়ে গেলাম। শীতের মধ্যেও বুঝতে পারলাম ঘামতে শুরু করেছি। পাপলু যেহেতু পরের ষ্টেশন বলেছিল তাই পরের ষ্টেশনে নেমে গেলাম। নেমে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলাম। কিছুই তো চিনিনা। যে ট্রেনে উঠেছিলাম সেগুলো ২ মিনিট পরপরই থামে। একটু পর দেখি পাপলু দৌড়ে আরেকটা ট্রেন থেকে নেমে আমার দিকে আসছে। মুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা আর অসহায় মুখ। ভাইকে হারিয়ে দিশেহারা অবস্থা। আমাকে দেখার পর একটু স্বাভাবিক হল। যত ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে জাপানে এসেছি সে তুলনায় এটি তেমন বড় কিছু নয়। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম আমি যদি পাপলুর পরের ষ্টেশনে নামার নির্দেশনা বুঝতে না পারতাম তাহলে বিপদই হত।তারপর আবার যাত্রা শুরু হল। ট্রেন পাল্টে আমরা অন্য ট্রেনে চড়ে ওদায়বা পৌঁছালাম । ওদায়বা একটা কৃত্তিম দ্বীপ । অসংখ্য দ্বীপ নিয়ে জাপান দেশ। কিন্তু এটির বৈশিষ্ট্য এটি কৃত্তিম ভাবে তৈরি । অসম্ভব সুন্দর করে তৈরি করা। আমার ভাষায় অসাম। প্রথমেই প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে চলে গেলাম।

 সাগরে কিছু জাহাজ চলছিল। চড়ার ইচ্ছা ছিল। সময় স্বল্পতায় চড়া হলোনা । সিগাল দেখলাম। প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম । আমি বিভূতিভূষণের মতো বা জীবনানন্দের মতো সে সৌন্দর্য বর্ণনা করতে পারবোনা তবে শুধু এটুকু বলি এগুলো আমার মনের মধ্যে সারাজীবন গেঁথে থাকবে। সেসব স্মৃতি মনে করে কষ্টের সময়েও কিছুটা শান্তি পাব।আমেরিকার আদলে তৈরি করা স্ট্যাচু অব লিবারটি দেখলাম। পাপলু অনেকবার গেছে সেখানে। তাই আমার মতো মুগ্ধ হলোনা। সেখান থেকে ভাইবোন একটা শপিং মলে চলে এলাম। সেখানে দেখলাম কুকুরছানা বিক্রি হচ্ছে দাম প্রায় পাঁচ লাখের কাছাকাছি। আমি প্রথমে ৫০০০ ভেবেছিলাম। দুইটা ০০ খেয়ালই করিনি। ঘুরে দেখলাম। জাপানে সস্তায় কিছু পাওয়া যায়না !সবকিছুই খুব ব্যয়বহুল মনে হলো। তারপর আমরা বাস ষ্টেশনে এসে দাঁড়ালাম । শপিং মলের পাশেই বাস দাঁড়ায় । ১১-৪৩ এ বাস আসার কথা ছিল । ১১-৪৩ এই আসল । আবার মুগ্ধ হলাম। আমি পাপলু আর দুই একজন ছাড়া বাসে কেউ ছিলোনা । এগুলো টুরিস্ট বাস। ভাড়াও লাগলনা। বাস চলতে শুরু করল। কোন হর্ন নেই ,নেই কোন জ্যাম।রাস্তাঘাট চমৎকার । 

আশেপাশের সবকিছুই ছবির মতো সাজান। কোথাও এতটুকু ময়লাও চোখে পড়লোনা। সেখান থেকে চলে এলাম মিরাইকানে। মিরাইকান হচ্ছে বিজ্ঞান জাদুঘর। ভেতরে ঢুকে অবাক হলাম। কত কিছু সেখানে। পদার্থ বিজ্ঞান , রসায়ন বিজ্ঞান এবং জীববিজ্ঞান যাতে সবাই বুঝতে পারে তার সবকিছুই আছে এখানে। বিজ্ঞান বিষয়টা যে মজার এবং মুখস্তের নয় এখানে আসলে বোঝা যাবে। সবকিছু সব সুন্দরভাবে বলা আছে সেখানে।ভাবলাম ইস ! আমার মেয়ে যদি এসব দেখতে পেতো । আমার মেয়ের বয়সী বেশ কিছু বাচ্চা দেখলাম। আমার মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল!সবাই ফর্সা ,লাল টুকটুকে গাল কিন্তু চোখ দুটো ছোট । সহজ সরল ভাবে বড় হচ্ছে। জীবন অনেক সহজ সেখানে। আগে কি ছিল বর্তমানে কি হচ্ছে আর ভবিষ্যতে কি হবে সবই দেয়া আছে জাদুঘরে । ভবিষ্যতে এক্সরে কেমন হবে সেটাও দেখলাম। ভবিষ্যতের ওষুধ এবং রোগ নির্ণয় পদ্ধতি কেমন হবে তারও ধারণা দেয়া আছে মিরাইকানে। সেদিন ছিল বাচ্চাদের জন্য ফ্রি । 

কিন্তু বড়দের ফ্রি ছিলনা। আমরা ঢোকার কোন টিকিট চেকারও চোখে পড়লো না। তাও বের হয়ে এসে টিকিট কাটলাম আমরা। তারপর ভাইবোন বার্গার আর ড্রিংকস খেতে থাকলাম। ট্র্যাভেল বাসের অপেক্ষায় থাকলাম । খাওয়া শেষ হতে না হতেই বাস চলে এল। এরপর গেলাম ভেনাস ফোরটে । খাসা জায়গা। ভেনিসের আদলে তৈরি । ইউরোপ ইউরোপ ভাব আছে। আমরা পুরোটা ঘুরে দেখলাম। ইউরোপের স্থাপত্য আমাকে আকর্ষণ করে । আমার খুব ভাল লাগল। ভেতরে কেনাকাটার ভাল ব্যবস্থা আছে তবে এক্সপেন্সিভ মনে হল। টয়োটা কার মিউজিয়ামে গেলাম। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। সেদিন বন্ধ ছিল । উঁকি দিয়ে যেটুকু দেখা যায় দেখলাম। খুবই সুন্দর জায়গা। যারা ভবিষ্যতে জাপানে আসবেন তারা অবশ্যই এই জায়গায় আসবেন। ঘোরা শেষ করে আমরা আবার ষ্টেশনের দিকে গেলাম। সুন্দর স্বপ্নের মতো সুন্দর একটা দিন কেটে গেল।

এরপর আমরা ট্রেনে চড়ে রোপ্পঙ্গির দিকে গেলাম। কেউ আবার চৌরঙ্গি বা সেরকম কোন এলাকা মনে করেন না। যদিও কলকাতার চৌরঙ্গি আমার কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় লেগেছিল।যাই হোক আমরা রোপ্পঙ্গি তে গেলাম। সেখানে শুভর অফিস। রোপ্পঙ্গি হচ্ছে টোকিওর মাঝে অবস্থিত। অভিজাত এলাকা।বাংলাদেশের গুলশানের মতো । অনেক দেশের এম্বেসি এখানে আছে। টোকিওর মাঝে বিখ্যাত এলাকা। যখন রোপ্পঙ্গি তে পৌঁছালাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পাপলু নিয়ে গেল শাহিফা কাবাব ঘরে। অভিজাত রেস্তোরাঁ । সবকিছু এক্সপেন্সিভ। শুভকে ফোন দেয়া হল। আমরা ঢুকে খাবার অর্ডার দিলাম। আমি নিলাম নান রুটি আর কাবাব। বাকীরা বিরিয়ানি খেল। 

আমি কিছু বিরায়ানির ভাগও পেলাম আর স্বগতোক্তির সাথে বললাম , না না কি দরকার ছিল!! অনেক বিল এল। কত বিল এল সেসব বলে আমি পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাইনা। খাবারের মান খুব ভাল। ওদায়বা তে অনেক হাঁটতে হয়েছিল। খিদেও লেগেছিল খুব। শাহিফা তে ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই সুপ দিয়ে গেল। কমপ্লিমেনটারি। খেতে খুব সুস্বাদু । হালাল খাবার। অনেক মুসলমানকে সেখানে খেতে দেখলাম। আমাদের খাবারের যে অর্ডার নিয়ে গেল তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান। খাবার খেয়ে তিনজন বের হয়ে রোপ্পঙ্গি তে হাটতে থাকলাম। শুভর অফিসের কাছে গেলাম। অভিজাত এলাকায় হাঁটতে ভালই লাগছিল। তারপর এক জায়গায় চা খেলাম। এত ভাল লাগল কিছু কিনে নিলাম। শুভ অফিসে চলে গেল। ভাইবোন ট্যাক্সি নিয়ে টোকিও টাওয়ার দেখতে গেলাম। টোকিও টাওয়ার প্রায় ১০০০ ফিট লম্বা। ১৯৫৮ সালে তৈরি করা হয়।আইফেল টাওয়ারের আদলে তৈরি করা। জাপানের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার টোকিও স্কাইট্রি । এর পরেই টোকিও টাওয়ার । 

আমরা ট্যাক্সি নিয়ে যখন গেলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফেরার তাড়া ছিল। উপরে আর উঠলাম না। আমার কিছুটা উচ্চতা ভীতি আছে যদিও প্লেনে উঠলে সেটা আর মনে থাকেনা। টাওয়ারের নিচে অনেক দোকান চোখে পড়ল । প্রচুর পর্যটক চোখে পড়ল । কোন বাঙালিকে দেখলাম না! তারপর আমরা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে টোকিও ডেন্টাল এন্ড মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলাম। পাপলু এখানেও কিছুদিন কাজ করেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসের শাহাঙ্গির ছিল সেখানে। ওকে ফোন দিলাম। এল। পিএইচডি করছে সেখানে। কাজের চাপে কিঞ্চিত বিধ্বস্ত । কিছুক্ষণ গল্প করলাম। মেডিকেলে যেতে চাইলাম। অনুমতি নেই তাই যেতে পারলাম না। একটা হাসপাতাল এমনই হওয়া উচিত। আজকাল হাসপাতালে প্রায়ই নানা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির খবর পাই। এর বেশীরভাগই ঘটে রোগীর সাথে থাকা উটকো লোকের কারণে । যাই হোক এরপর আমরা বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম। ফেরার পথে ফাইজান কে হোকুইন থেকে নিতে গেলাম। আমাকে ভেতরে যেতে দিল কিন্তু একেবারে ভেতরে যেখানে বাচ্চারা থাকে সেখানে যেতে দিলনা। বাচ্চাদের চমৎকার ব্যবস্থা হোকুইনে । 

খেলাধুলা ,খাবার খাওয়ানো ,ঘুম , পড়া সবকিছুর ব্যবস্থা আছে সেখানে। আমাদের এখানে কর্মজীবী মায়েরা খুব কষ্ট পায় । বাসায় বাচ্চা রেখে যেয়ে তারা অফিসে তেমন মন বসাতে পারেনা। সবসময় টেনশনে থাকতে হয়। এসব পরিস্থিতির ভাল সমাধান হোকুইন। কবে আমাদের দেশে হবে এসব?ফাইজান মা আর মামাকে একসাথে দেখে খুবই খুশি হল। তারপর আমরা আড়াই জন মিলে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম।বাসায় এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। তারপর শুরু হল আবার খাবার দাবারের অত্যাচার । ভরপেট খাবার পর কিছুটা নিদ্রার আমেজ অনুভব করলাম। টিভি দেখলাম। জাপানি প্রোগ্রাম হচ্ছে। খুব একটা উৎসাহ পেলাম না। রাতে চমৎকার আড্ডা হল। ২৩ তারিখ হিরোশিমা যেতে হবে। প্লেনের টিকিট কাটা ছিল। জাল এয়ারলাইন্সে। গল্প করতে করতে ঘুম এসে গেল। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই। পাপলুর চিৎকারে ঘুম ভাঙল। প্রবল ভূমিকম্প টের পেলাম। সবার আতংকিত মুখ। এত ক্লান্ত ছিলাম চোখও পুরোপুরি খুলতে পারছিলাম না। নিচে নামতে হবে কিনা সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হলোনা। জাপান হচ্ছে ভূমিকম্পের দেশ। তাদের এমন শত শত অভিজ্ঞতা আছে। আমি সেখানে নতুন। ভয় আমারই পাওয়ার কথা। কেন জানি পেলাম না। অতিরিক্ত ক্লান্তিও একটা কারণ হতে পারে। আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। সকালে এই নিয়ে অনেক হাসাহাসি হল। দেশে ফেরার পর ওয়ার্ডেও এই নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। আমি জাপানে গেলাম আর পরেরদিনই ভূমিকম্প হল!!ব্যপারটা আসলে কাকতালীয় । এর সাথে আমার বা কারো কোন সম্পর্ক নেই।

ভেবেছিলাম একা একা জাপান ঘুরবো । কিন্তু কি ভাবলাম আর কি হলো। পাপলু একা একা কোথাও বের হতে দিবেনা। কি আর করা। পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে। পরের দিন সকালে খিচুড়ি আর ডিমের ভাজির আয়োজন ছিল। সাথে ছিল আম্মার দেয়া আচার। সবচেয়ে বেশী যেটা ভাল লাগছিল তা হচ্ছে তাজা ফল। পাপলু আমার জন্য বেশ কিছু ফল কিনে রেখেছিল। টাটকা ফলের স্বাদই আলাদা। চা খাওয়া হলো বেশ কয়েকবার। তারপর বের হলাম। প্রথমে গেলাম টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে । ট্রেনে গেলাম। পাপলুর কর্মস্থল ।বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতেই মানুষ সহ একটি কুকুরের মূর্তি দেখলাম। কুকুর প্রভুভক্ত আমরা জানি। কিন্তু মূর্তির পেছনের ইতিহাস জেনে চমকিত হলাম। কুকুরটি তাঁর মালিক, টোকিও বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর উয়েনোর জন্য জন্য টানা দশ বছর ধরে ট্রেন স্টেশনে অপেক্ষা করেছিল। এই অসামান্য ঘটনার সম্মানে বানানো হয়েছে মূর্তি।পরে দেখা হয়েছিল কিনা জানিনা । অদ্ভুত ঘটনা সন্দেহ নেই। মানুষ কত অকৃতজ্ঞ আর সেখানে...।

এগিয়ে গেলাম কিছুদূর । মেডিকেল ফ্যকালটি চোখে পড়ল । বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনেকটা ইউরোপীয় ধাঁচে তৈরি। আমি আগেই বলেছি আমি ইউরোপীয় স্থাপত্যের গুণমুগ্ধ ভক্ত। প্রথমে গেলাম স্টুডেন্ট সেন্টারে । সেখান থেকে গেলাম ক্যফেটেরিয়াতে। ছাত্র ছাত্রীরা বসে নাস্তা করছিল। ভাইবোন বসে কফি খেলাম। আমাদের প্ল্যান ছিল সারাদিন টোকিও ঘুরবো । দ্রুত বের হয়ে এলাম। আজ আর এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ হলোনা । বিশ্ববিদ্যালয় হেঁটে হেঁটে যতদূর সম্ভব ঘুরে দেখলাম। মেধাবী পরিশীলিত শান্ত মানুষগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশ কয়েকজন নোবেল পুরস্কারও পেয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাদের অনেকের ভাস্কর্য তৈরি করে রাখা হয়েছে এখানে সেখানে। কোন হৈচৈ হট্টগোল দেখলাম না। বিভিন্ন দেশের ছাত্র ছাত্রী চোখে পড়ল ।বেশ কিছু মনোমুগ্ধকর রঙিন গাছপালা চোখে পড়ল । 

চিনতে পারলাম না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক ( বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী ) ডঃ নাদেরুজ্জামান চাচা আমাকে অনেক গাছ চিনিয়েছিলেন। তার কথা হঠাৎ মনে পড়ল। এরপর আরও কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। মুগ্ধ হয়ে সেখান থেকে বের হলাম। ট্রেনে উঠলাম । ডায়েটে চলে গেলাম। ডায়েট জাপানের সংসদ ভবন। ডায়েট টোকিওর চিওদাতে অবস্থিত এবং ১৯৪৭ সালে তৈরি হয়। অপূর্ব সুন্দর দেখতে। চারিদিক দিয়ে ঘুরে দেখলাম। চমতকার,খাসা, উৎকৃষ্ট সহ আরও যা যা বিশেষণ সবই এর জন্য প্রযোজ্য । ভেতরে যাবার সুযোগ ছিল। কিন্তু তার জন্য ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করতে হবে। দ্বিধায় পড়লাম । একজনকে অনুরোধ করলাম। লাভ হলোনা । জাপানীরা নিয়মের প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল । এজন্য চারপাশের সবকিছু খুব স্নিগ্ধ মনে হয়। বিশৃঙ্খলা চোখে পড়েনা। আশেপাশে অনেক সুরম্য অট্টালিকা চোখে পড়ল । জানতে পারলাম সেগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং অফিস। খুবই সুন্দর লাগছিল দেখতে। তারপর আবার ট্রেনে চড়ে ইম্পেরিয়াল প্যলেসে গেলাম। মাত্র ২ মিনিটের মতো সময় লাগলো । ইমেপেরিয়াল প্যলেসে রাজা এবং তার পরিবার থাকেন।

 বিরাট পার্কের মতো এলাকা। সুন্দর বাগান চোখে পড়ল । প্রায় ৩ বর্গকিলোমিটারের মতো বড় । ভাইবোন অনেকদূর হেঁটে হেঁটে ঘুরলাম। পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল । বসারও ব্যবস্থা আছে। অনেক পর্যটক আসে সেখানে। বিরাট এক মাঠ আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে ভয়ংকর রকমের সুন্দর লাগে। ভাবলাম মাঠে বসে থাকি। পাপলুর আমেরিকা যাবার তাড়া ছিল। মাত্র ১০ দিনের ছুটি নিয়ে গিয়েয়েছিলাম। মনে হল বিরাট ভুল হয়েছে। কিন্তু উপায় ছিলনা। বেঁচে থাকলে ইনশাআল্লাহ্ আবার যাব । মাঠে বসে থাকব। এত সুন্দর জায়গা বারবার দেখলেও মনের সুখ মিটবেনা। তার ভেতরে যেখানে রাজা এবং তার বংশধর থাকেন সেদিকে বেশ কড়াকড়ি । কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়না। রাজাকে খুব সম্মান করে তারা। অত্যন্ত ভাল অভিজ্ঞতা নিয়ে বের হয়ে এলাম। তারপর ট্রেনে চড়ে আবার চলে গেলাম ইকেবুকরো। ইকেবুকরো কে বংলাদেশের গুলিস্থানের সাথে তুলনা করা যেতে পারে! অনেক ভিড় চোখে পড়ল । বাংলাদেশের শহীদদের স্মরণে একটা শহীদ মিনার আছে সেখানে। 

খুব ক্ষুধা লেগেছিল। ম্যনহাটন ফিশ বিখ্যাত খাবার দোকান । সেখানেই খাওয়া হলো । অনেক ধরণের সামদ্রিক মাছ খেলাম। অপূর্ব স্বাদ । কিভাবে যে এত সুস্বাদু বানাল অবাক হয়ে গেলাম। ঝাল লবণ সব পরিমাণ মত।পরে আরেকদিন খেয়েছিলাম। সেদিনও একইরকম ভাল লেগেছিল। বিভিন্ন দেশে এর ব্রাঞ্চ আছে। শুনেছি ঢাকাতেও নাকি হয়েছে। আমি নিশ্চিত নই এই ব্যপারে। এরপর আইসক্রিম খাবার পালা। বাস্কিন রবিন্স আর হ্যগেন ডায এর আইসক্রিম খেলাম। তুলনাহীন । খাওয়াদাওয়া শেষ হলে গেলাম টোকিও ডোম সিটিতে । অনেক কিছু আছে সেখানে। টোকিও ডোম স্টেডিয়াম দেখলাম। চমৎকারভাবে তৈরি করা। ১৯৮৮ সাল থেকে নানা ধরণের খেলাধুলা এখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পাশেই একটা পার্কে গেলাম। বিভিন্ন রাইড আছে সেখানে। এক ধরণের রোলার কোস্টার দেখলাম। যেভাবে যাচ্ছিল দেখে খুব ভয় লাগল । পাপলু বলল ,উঠবি কিনা? ভয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করলাম। এত তাড়াতাড়ি কবরের আজাব ভোগ করতে চাইনা!! কোরাকুয়েনে গেলাম। অসাধারনভাবে সেখানে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। টোকিও ডোম হোটেলের স্থাপত্যও অতি মনোরম । রাত হয়ে যাচ্ছিল । ট্রেনে চেপে আবার অজি কামিয়াতে চলে আসলাম। সেখান থেকে হেঁটে বাড়ী । মনের ভেতর অসাধারণ টোকিওর চেহারা চিরদিনের জন্য গেঁথে রইল। এই মুগ্ধতা কখনই শেষ হবার নয়...

২৩ তারিখ ভোরে ফ্লাইট ছিল হিরোশিমার । ৪ টার দিকে ঘুম থেকে উঠলাম । বাসা থেকে হেনাদা এয়ারপোর্ট কাছে। পৌনে পাঁচটার দিকেই বেরিয়ে পড়লাম । ফাইজান ছিল। একটুকুও ঝামেলা করল না। সবাই যেয়ে ট্রেনে উঠলাম । সেই ভোরে দেখি ট্রেনে অনেক ভিড় । পাপলু শুভ বলল এটা নাকি স্বাভাবিক ঘটনা । আমার খুব অবাক লাগল শেষ রাতের দিকে অনেকে অফিস যাচ্ছে । অনেকে ৩০০ কিমি দূরে যেয়ে অফিস করেন। ট্রেন যোগাযোগ অস্বাভাবিক রকম ভাল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তাতে রাজধানী টোকিওর উপর চাপ কমে গেছে। আমদের দেশেও এমন হলে ঢাকার জট অনেক কমে যাবে। তাহলে রাজশাহীতে থেকেও প্রতিদিন ঢাকায় অফিস করা যাবে !! কবে আসবে এমন দিন? খুব তাড়াতাড়ি হেনাদা এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম।ফাইজান কুনের ছোট্ট গাড়ী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জাল এয়ারলাইন্সের ভেতর চলে গেল। 

কুন মানে বাচ্চা। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেনে যেয়ে উঠলাম । ভেতরটা খুব সুন্দর। আমি যত প্লেনে চড়েছি তার মধ্যে এটি সবচেয়ে ভাল মনে হয়েছে। প্লেন ছাড়ল । মনে হল সমদ্রের মাঝ থেকে বিমান উঠে গেল। এয়ারপোর্টের কিছু অংশ সমুদ্রের মাঝে দেখলাম। ১৯৭৮ সালে এটি তৈরি হয়। আমি মুগ্ধ হয়েই চলেছি। আমাদের মেডিকেলের অনেক স্যার জাপান গেছেন। তাদের কাছেও জাপান সবচেয়ে ভাল লেগেছে। এমনকি ইউরোপ আমেরিকা দেখে আসার পরেও ।এক ঘণ্টার কিছু বেশী সময় লাগল। হিরোশিমায় পৌঁছে এয়ারপোর্টেই নাস্তা খেলাম। ভালই লাগল । আমাদের সারাদিনের জন্য গাড়ী ভাড়া করা ছিল। শুভ নিজেই গাড়ী ড্রাইভ করল। খুব সুন্দর গাড়ী চালায় ও । আমি পাশে বসলাম। পাপলু ফাইজান পেছনে বসল । ফাইজান কে সিটের উপর আরেকটা সিট দিয়ে সিট বেল্টের সাথে বাঁধা হল। একটু উসখুস করতে লাগল । যাই হোক বাচ্চাদের জাপানে ঈর্ষনীয় নিরাপত্তা চোখে পড়ল । ছোট বাচ্চারা যাতে কোন বিপদে না পড়ে তার সব ব্যবস্থাই আছে সেখানে। 

হিরোশিমায় গাড়ী কিছুদূর যেতেই মনটা কেমন করে উঠল । ছোটবেলায় হিরোশিমা নাগাসাকির যে যে ঘটনা পড়েছিলাম সব আবছা ভাবে মনে পড়তে থাকল । মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল । কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম হিরোশিমা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে । ধ্বংসস্তূপ থেকে ৭০ বছরের মধ্যেই আবার এত সুন্দরভাবে সব সাজিয়েছে বিশ্বাস করাই মুশকিল। একবার ভাবলাম সত্যিই হিরোশিমা এসেছি তো ? ভেবেছিলাম কোন বিধ্বস্ত নগরী দেখব। কি ভেবেছিলাম আর কি দেখছি। তারপর যেখানে বোমা পড়েছিল ঠিক সেই জায়গার কাছাকাছি চলে গেলাম। গাড়ী পারকিং করা হল। যা দেখলাম সেটিও বিস্ময়কর । চোখের সামনেই গাড়ী অনেক উপরে উঠে গেল! জাপানের লোকসংখ্যা অনেক । প্রায় ১২ কোটিরও বেশী । সেজন্য জায়গা অপচয়ের ব্যপারে তারা খুব সাবধানী । বাড়িঘর সব ছোট ছোট । কোথাও বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ী নেই। 

গাড়ী থেকে নেমে হাঁটা ধরলাম। বোমা ফেলার পর সবকিছু ধ্বংস হলেও একটা বাড়ী টিকে ছিল। সেই বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম । মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। ১৯৪৫ সালের ৬ ই আগস্ট ফিরে গেলাম। মনে হল চোখের সামনেই সব ঘটছে । সেদিন সকালেও সবাই কাজে বেরিয়েছিল । সকাল ৮- ১৫। কেউ ভাবতেই পারেনি কি হতে যাচ্ছে । হঠা ৎ করেই সব শেষ । কেউ বুঝতেই পারেনি কি হয়েছে। ১০ ফুটের মত লম্বা ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধ লিটল বয় এক নিমিষে হিরোশিমার মানুষের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিল। শহরের প্রায় ৯০ ভাগ ধ্বংস হয়ে গেল। সাথে সাথে ৮০ হাজারের কাছাকাছি মানুষ করুণভাবে মৃত্যুবরণ করল। পরবর্তীতে আরও ৮০ হাজারের মত মানুষ মারা গিয়েছিল রেডিয়েশন সংক্রান্ত জটিলতায় । সেই বাড়িটার পাশেই একটা নদী । জানতে পারলাম মানুষ আর রক্তে সেটা নাকি ভরে গিয়েছিল। 

নাহ মনটা খুব বেশী খারাপ হয়ে গেল। মানুষ কেন এমন হয়? এত নিষ্ঠুর কেন মানুষ ? অবশ্য জাপানীরাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনেক অত্যাচার করেছে। বিশেষত চীনের নানকিং এ তাদের অত্যাচারের কাহিনী পড়ে শিওরে উঠেছি । সূরা ত্বিন এর একটা আয়াত মনে পড়ে গেল, “ আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোৎকৃষ্ট রূপে এরপর তাকে নামিয়ে দিয়েছি নিম্ন থেকে নিম্নতর স্তরে “। কোন নৃশংসতাই সমর্থনযোগ্য নয়। যে বাড়ীটা টিকে ছিল অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। চারিদিক ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এত খারাপ লাগবে জানলে হিরোশিমা আসতামই না!! হিরোশিমা মেমোরিয়াল পার্কে তারপর গেলাম। হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল । চোখের কোনা বারবার ভিজে উঠছিল। ছোট ছোট বাচ্চাদের কথা বারবার মনে হচ্ছিল। আমার মেয়ের কথা মনে হচ্ছিল। একটা শিশুর কি অপরাধ থাকতে পারে ??

 কেন তাদের বিনা কারণে এভাবে অসহায় ভাবে মরতে হল??কেন ? যাই হোক মেমোরিয়াল পার্কের স্মৃতিস্তম্ভের কাছে গেলাম। বারাক ওবামা কিছুদিন আগে এখানে এসেছিলেন। খুব আবেগপ্রবণ হয়েছিলেন তাও শুনলাম। এরপর আমরা মিউজিয়ামে চলে গেলাম। প্রত্যেকটা জিনিশ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। অনেক অনেক কিছু আছে সেখানে। সবকিছু তারা সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করেছে। বিভিন্ন মদেলের সাদাকোর জামাকাপড় দেখলাম। সাদাকোর গল্প পরের পর্বে করা যাবে । সেই সময়ের ভিডিও দেখলাম। খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে সব। অনেককেই কান্নাকাটি করতে দেখলাম। বিষাদে ভরে গেল মন। স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না কিছুতেই। অ্যাটম বোমা বিরোধী প্রচার অভিযান চলছিল। সেখানে লিখলাম, “ I am very much shocked to see all this ,hope this will never occur in any part of the world.” জানি আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের এই আবেদন যারা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে আছে তাদের কানে পৌঁছাবে না। তারপরেও কিছুটা শান্তি পেলাম। মনটা একটু হালকা হল ।

নবম খণ্ড সাদাকোর কাহিনি নিয়ে। মাত্র বার বছর বয়সেই তাকে চলে যেতে হয় পৃথিবী ছেড়ে। তবুও এক অর্থে ভাল। বেশীদিন তাকে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা দেখতে হয়নি! তবে যেটুকু নিষ্ঠুরতা সে দেখেছে সেটাও কোন মতেই কম নয়। যে বয়সে তার পুতুল খেলার কথা সে বয়সে সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেঁদেছে । সহ্য করতে হয়েছে একটার পর একটা ইঞ্জেকশন। ১৯৪৩ সালের ৭ ই জানুয়ারি তার জন্ম। অন্যান্য জাপানি বাচ্চার মতো আদরেই বড় হচ্ছিল সে। ১৯৪৫ এ যখন বোমা হামলা হয় তখন তার বয়স মাত্র ২। তার বাসা থেকে ২ কিলোমিটার দূরে অ্যাটম বোমা পড়েছিল । ছিটকে পড়েছিল সাদাকো । মা ভেবেছিলেন মরেই গেছে। দাদী দৌড়ে এসেছিল। যদিও পরে আর দাদীকে জীবিত অবস্থায় কেউ দেখেনি। মা আর সাদাকো কে নিয়ে পালাচ্ছিল । পালাচ্ছিল। ব্ল্যক রেইন তাদের ধরে ফেলল । অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশনের প্রভাবে কালো বৃষ্টি হচ্ছিল যার মধ্যে ছিল উঁচুমাত্রার ক্যন্সার তৈরিকারী পদার্থ । 

সৃষ্টিকর্তা মনে হয় অন্যরকম কিছু ভেবেছিলেন। সাদাকো বেঁচে গেল। হিরোশিমা আবার ঘুরে দাঁড়াতে থাকল । সাদাকো স্কুলে ভর্তি হল। সবার ভালবাসার ছিল সে। রিলে টিমের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও হয়ে গেল। ভালই চলছিল দিন ।১১ বছর বয়সে হঠাৎ একদিন তার খারাপ লাগল । জ্বর এল। বাবা মা গুরুত্ব দিলেন না। কয়েকদিন পর গলাব্যথা আর গলার বাইরে চামড়ার নিচে গুটি দেখা গেল। ভাল লাগছিল না কিছু সাদাকোর । সে বুঝতে পারছিলনা কেন এমন হচ্ছে। কেন এমন লাগছে? সে কখনো চিন্তাও করেনি কি ভয়ংকর অসুখ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে । চিকিতসা না করলে কয়েক সপ্তাহেই যে অসুখে জীবন প্রদীপ নিভে যায় । তার বাবা মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার বুঝতে পারলেন কি হয়েছে। নিশ্চিত হবার জন্য ব্লাড টেস্ট দিলেন। রোগ ধরা পড়ল । ব্লাড ক্যন্সার। কয়েকদিনের মধ্যে শরীরে রযংকশ দেখা গেল। রেড ক্রস হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হল। বিছানায় শুয়ে সাদাকো কাঁদত আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকত । খুব কষ্ট হত তার। সে সেময় এখনকার মতো এত ভাল ভাল ওষুধও ছিলনা। রক্ত দেয়া হত। শারীরিক অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যাচ্ছিল । 

অবর্ণনীয় কষ্ট । তার সমবয়সীরা যখন খেলছে , পড়ছে আর সে হাসপাতালের নিষ্ঠুর বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে । আস্তে আস্তে অবস্থা আরও জটিল হল । তাকে অন্য রুমে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে যে ছিল সে ছিল তার থেকে ২ বছরের বড় । একটা কাহিনী শোনাল সে সাদাকোকে। কেউ যদি ১০০০ অরিগ্যমি ক্রেন বানাতে পারে তবে স্রষ্টা তার ইচ্ছা পূরণ করেন। সাদাকোর তখন একটাই ইচ্ছা। শুধু বাঁচার ইচ্ছা। আর কিছুই না । অরিগ্যমি হচ্ছে কাগজ দিয়ে বানানো বিভিন্ন শিল্পকর্ম । এত সুন্দর দেখতে খুব ভাল লাগে। জাপান অরিগ্যমির জন্য বিখ্যাত । শুধু কাগজ দিয়ে যে এতকিছু বানানো যায় বিশ্বাসই হতে চায়না। সাদা কো অরিগ্যমি ক্রেন বানানো শুরু করল। ক্রেন মানে সারস পাখি। বেশ কিছু বানিয়ে ফেলল । কিন্তু এত কাগজ পাবে কোথায় । যে কাগজে চিকিৎসা দেয়া হত সে কাগজ দিয়েও বানানো শুরু করল। 

একটাই লক্ষ্য ১০০০ বানাতে হবে। অন্য ঘরে যেয়েও কাগজ চেয়ে নিয়ে আসতো । প্রতিদিনই বানাচ্ছে আর প্রতিদিনই একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে আগাচ্ছে। ৬৪৪ টা বানিয়ে ফেলল । আর মাত্র ৩৬৬ টা বাকী । সেসময় আর কিছুই খেতে পারছিলনা সাদাকো । রুচি সব চলে গিয়েছিল । ভাতের উপর চা দিয়ে খেতে চাইল সে। দেয়া হল । সেই যে শেষ খাবার কে ভেবেছিল ! সাদাকো নিশ্চয়ই ভাবতে পারেনি । “খুব সুস্বাদু “ এই শেষ কথা বলে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ল । বন্ধুরা অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল । বাসা থেকে তারা অরিগ্যমি ক্রেন বানিয়ে নিয়ে আসল । ১০০০ টা পূর্ণ হলো । কিন্তু সাদাকো তো আর নেই। কি হবে সেসব দিয়ে। ১০০০ টা অরিগ্যমি ক্রেন দিয়ে তাকে সমাহিত করা হলো । যদিও জাদুঘরে বলা আছে সাদা কো ১০০০ এর বেশী বানিয়েছিল তবে তার বাবা এবং বন্ধুরা বলেছিল সে ৬৪৪ টি বানিয়েছিল। তার কিছু নমুনা আমি জাদুঘরে দেখেছি। অনেক কষ্টে কান্না থামালাম। এসব দেখে মানুষ অধিক কষ্টে কাঁদতেও ভুলে যাবে। যদিও জাপানীরা সাদাকো কে ভুলে যায়নি । প্রতি বছর ৬ ই আগস্ট তার কাহিনী পড়ে শোনান হয় সবাইকে । তাকে নিয়ে সিনেমা হয়েছে। তার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনেক কিছু করা হয়েছে। সাদাকো চলে গেছে অন্য কোথাও অন্য কোন খানে। কিন্তু নাড়া দিয়ে গেছে বিশ্বকে । কাঁদিয়েছে সবাইকে। নাড়া দিয়ে যাবে অনেকদিন। আমার শুধু একটাই প্রার্থনা কোন বড় মানুষের নিষ্ঠুরতার বলি যেন কোন শিশু না হয়। এটা সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য । পৃথিবীর কোন শিশু যেন কখনোই বর্বরতার স্বীকার না হয়। হোক না সেই ফিলিস্তিনে বা ইরাকে। সিরিয়ায় বা বার্মায় ......

মনটা বিষাদে ভরে গেল। কিছুই ভাল লাগছিলনা। হিরোশিমায় এসব দেখে সবারই খারাপ লাগবে। বিষাদময় জায়গা। দুপুর হয়ে গিয়েছিল। খাবার সন্ধানে বের হলাম। শুভ আগে থেকেই খাবার হোটেল আর থাকার হোটেল ঠিক করে রেখেছিল। টার্কিশ হোটেলে খেতে গেলাম। কাবাব আর নান খেলাম। স্যুপ ও ছিল। আসলে মনটা আমার এত খারাপ ছিল  যে শুধু খেতে হয় বলে খেলাম। পাপলু আর শুভর মনের অবস্থাও একই ছিল। তবে শুভ আগেও এখানে এসেছিল। নাগাসাকি যাবার ইচ্ছে ছিল।  নাগাসাকিতে ৯ আগস্ট  বোমা পড়েছিল । সেখানেও বহু হতাহত হয়েছিল। সময় স্বল্পতায় যাওয়া হলোনা । খাবার পর আবার বের হলাম গাড়ী নিয়ে। হিরোশিমা শহরের মধ্যে দিয়ে আমরা চললাম মিয়াজিমার দিকে। মিয়াজিমা জাপান সাগরের একটা দ্বীপ । জাপানি ভাষায় মিয়াজিমা মানে মঠের দ্বীপ । অনেক মঠ চোখে পড়ল সেখানে। কেউ কেউ প্রার্থনাও করছিল। এই জায়গা এসে সব মানুষেরই মন ভাল হবে। আল্লাহ্‌র সৃষ্টি এই পৃথিবী সত্যিই অপরূপ । আমি ঘুরে বেড়াতে চাই এই পৃথিবীর সব জায়গা। মহান সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই আমার এই শখ পূরণ করবেন। কিছু হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছিল মিয়াজিমা দ্বীপে । 

এগুলো বিলুপ্তপ্রায়। হরিণগুলোকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দেখলাম। প্রচুর পর্যটক চোখে পড়ল । সামুরাই যোদ্ধা দেখলাম। না আসল সামুরাই না । সেরকম পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে । সামুরাই ছিল মধ্যযুগে মহান যোদ্ধা । সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করত। নৈতিকতার দিক থেকে তারা ছিল খুব উঁচুমানের । ছবি তুললাম সামুরাই !! এর সাথে। তাদের পোশাক পরে ছবি তোলা যেত তবে তার জন্য ইয়েন লাগবে। জাপানে ফ্রি কিছু পাওয়া যায়না । অনেক উঁচু এক প্যগোডা চোখে পড়ল । পরে জানলাম সেটা পাঁচ তলা বিশিষ্ট । মিয়াজিমার প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাম। পর্যটকের জন্য অনেক  সুবিধা আছে। ফেরী পেতে কোন সমস্যা হয়না। একটু পরপরই পাওয়া যায় । আমাদের সেন্ট মারটিন দ্বীপ অসম্ভব সুন্দর। অথচ একবারের বেশী ফেরি পাওয়া যায়না । অনেকে রিস্ক নিয়ে ট্রলারে  সেখানে যায় । এসব নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথাও দেখিনি। যাই হোক হেঁটে হেঁটে মিয়াজিমা দ্বীপ অনেকখানি ঘুরলাম। হিরোশিমা দেখে যে নিঃসীম শূন্যতায় ডুবে গিয়েছিলাম মিয়াজিমা দেখে আবার ভেসে উঠলাম । মিয়াজিমা দ্বীপের আয়তন প্রায় ৩০ বর্গকিলোমিটারের মতো । লোকসংখ্যা ২০০০ বা তার থেকে কিছু বেশী । ৫০০ বছরের পুরনো ।  পাহাড় এবং বনও চোখে পড়ল । মহেশখালীর কথা মনে পড়ল । 

অথচ মহেশখালীতে আমাদের অনেক রিস্ক নিয়ে ট্রলারে  যেতে হয়েছিল। যাতায়াত  আর নিরাপত্তা উন্নত করলে অনেক পর্যটক আমাদের দেশেও আসবে। কারণ আমদের দেশটাও সত্যিই অনেক সুন্দর। তারপর ফেরীতে করে আবার ফিরে আসলাম। গাড়ী পার্ক করা ছিল। শুভ চালিয়ে হোটেলে নিয়ে এল। হোটেল ছিল হিরোশিমা মেমোরিয়ালের পাশে। ভেবেছিলাম রাতে গিয়ে আবার সব  দেখব। কিন্তু দেখা হ লোনা জাপানি হোটেল খুব সুন্দর। রাতে পরার জামা কাপড়ও দিল। সবকিছু ঝকঝকে তকতকে। হোটেলের জানালা দিয়ে রাতের হিরোশিমা দেখলাম। ভাবলাম ১৯৪৫ সালে সেদিনের রাতে কি অবস্থাই না ছিল এখানে। রুমে খাবার পানি বেশী ছিলনা। কাউনটারে যেয়ে বললাম। ২-৩ মিনিট বলার পরেও কিছুই বুঝলনা। আমি খুবই অবাক হলাম। বেসিক ইংরাজি তো সবার জানা উচিত।ভাগ্য ভাল  শুভ গাড়ী পারকিং করে  ঠিক সেই মুহূর্তে এসে হাজির। পানি নিয়ে রুমে চলে আসলাম। রাতে আর বের হওয়া হলোনা। খুব ক্লান্ত ছিলাম। 

সকালে বুফে ব্রেকফাস্ট খেলাম। স্যুপ, পাউরুটি,ডিম , বাটার , ফলমূল , মাছ, গ্রিন টি খেলাম। মাত্র ২ জন মিলে মহিলা খাবারের বিষয় দেখভাল করছে। বয়স প্রায় ৬০ -৬৫ হবে। সে বয়সেই যে পরিশ্রম করছে আমাদের  দেশের অনেক ২৫-৩০ বছরের মানুষও সে পরিশ্রম করতে পারবেনা। কেউ কেউ হয়তোবা আমাদের দেশেও অনেক পরিস্রম করে। কিন্তু  একটা দেশের সবাই যদি পরিশ্রমী না হয় তবে একটা দেশ কখনই শীর্ষে যেতে পারবেনা। পরিশ্রমের একটা বিরল দৃশ্য আমি দেখেছিলাম চীনে । সে গল্প পরে করব। আমরা হোটেল থেকে বের হলাম। ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম ষ্টেশনে । শিনকান্সেন এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। ট্রেন চলে এল। ফাইজান কুনের ভাষায় দেনসা । ও দেনসা খুব পছন্দ করে। শিনকানসেন ঘণ্টায় প্রায় ৩০০ কিলোমিটার যায় । সে হিসেবে ৪৫ থেকে ৫০ মিনিটে রাজশাহী থেকে ঢাকা পৌঁছার কথা!! শিনকানসেন এ চড়ার খুব শখ ছিল। সৃষ্টিকর্তা মনের আশা পূরণ করলেন। ট্রেন চলতে শুরু করল। আমি জানলার পাশে বসলাম । পাপলু শুভই ব্যবস্থা করে দিল । আমার সুযোগ সুবিধার দিকে তারা যেভাবে দৃষ্টি রেখেছিল আমি সত্যই অভিভূত ।  অপলক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকলাম। আমাদের গন্তব্য জাপানের প্রাচীন রাজধানী  কিয়োটো তে। ট্রেনে খাবার বিক্রি হচ্ছিল। পেপসি খেতে খেতে কিয়োটো এর দিকে যেতে থাকলাম। জানালা দিয়ে অপরূপ জাপান চোখে পড়ল ...

বিসিএস পরীক্ষা দেবার সময় কিয়োটো প্রটোকল পড়েছিলাম । সেই কিয়োটো তে যেয়ে এত তাড়াতাড়ি হাজির হব ভাবিনি। এক হাজার বছর ধরে জাপানের রাজধানী ছিল কিয়োটো । তারপর সেখান থেকে টোকিও তে স্থানান্তর করা হয়। শিনকান সেন এ চড়ে খুব ভাল লেগেছিল। খুব দ্রুত চলে এলাম। তারপর নেমে বাসে উঠলাম । ফাইজান একটু কান্নাকাটি করছিল দেনসা দেখবে বলে। শিনকানসেন ও খুব পছন্দ করে। যাই হোক বুঝিয়ে নিয়ে বাসে উঠলাম । আমাদের গন্তব্য ছিল গোল্ডেন টেম্পল । খুব বিখ্যাত । বাসে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল ।বাসে একজন কিঞ্চিৎ রাফ ব্যবহার করল। জাপানে অবস্থানকালীন এই একজনের ব্যবহারই রাফ মনে হয়েছে আমার! অবশ্য আমি আর পাপলু অতিরিক্ত হাসাহাসি করছিলাম সেটা একটা কারণ হতে পারে। তবে লোকটার চেহারা সুরতও সুবিধার ছিলনা। 

দেখে মানসিকভাবে অসুস্থ মনে হয়। এরপর গোল্ডেন টেম্পলে হাজির হলাম আমরা। অনেক ভিড় ছিল। তবে জাপানে সব কিছু সুশৃঙ্খলভাবে সাজান। কোন বিশৃঙ্খলা চোখে পড়েনা । ভেতরে ঢুকে গোল্ডেন টেম্পলে চলে গেলাম। অপূর্ব । প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো । চারিদিক থেকে দেখলাম। যেদিক দিয়েই দেখিনা কেন সুন্দর লাগে। বেশ কয়েকবার পুড়েছে এটি । একবার ১৪৭০ সালের দিকে আরেকবার ১৯৫০ সালের দিকে। ১৯৫০সালে মঠের একজন সন্ন্যাসী আগুন দিয়েছিল। তারপর আত্মহত্যার চেষ্টা করে আবার বেঁচেও যায় । ৭ বছরের জেল হয় তার কিন্তু মানসিক অসুস্থতার জন্য দ্রুত ছাড়া পায়।পরে অবশ্য সেই সন্ন্যাসী যক্ষ্মায় মারা যায় । বেশ কয়েকবার সংস্কারও করা হয়েছে গোল্ডেন টেম্পল । সোনার পাতে মোড়ানো । কতটুকু সোনা ব্যবহার করা হয়েছে সেটাও একজায়গায় দেখলাম। ভুলে গেছি। পরে মনে পড়লে বলা হবে। জাপানের এবং বাইরের দেশের অনেক পর্যটক চোখে পড়ল । ভেতরটা অনেক বড় । আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ছোট একটা পাহাড় আছে ভেতরে। উঠলাম। ওয়াসাবি ফ্লেভারের বাদাম খেলাম। সুস্বাদু খুব। তারপর বের হলাম। বেশ কিছুদূর এসে ট্যাক্সি নিলাম। দুপুর হয়ে গিয়েছিল। ক্ষুধা লেগেছিল সবার। দোকান থেকে কিছু কেনা হল। ফাইজান কিছু খেতে চাচ্ছিলনা। 

হালকা চাটি খেল মায়ের! A hungry man is an angry man. তারপর এক মুসলিম রেস্তোরাঁতে গেলাম। অনেক ভিড় ছিল। আমদের ঘণ্টা খানেক বসতে বলল।আমাদের ফ্লাইট ছিল রাতে। ওসাকা থেকে টোকিও তে। বাসে কিয়োটো থেকে ওসাকা যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। তাই আমরা হোটেলে আর খেলাম না। সরাসরি যেয়ে বাসে উঠে ওসাকার দিকে রওনা দিলাম। সুন্দর বাস ছিল। আরামদায়ক ভ্রমণ । বাস একেবারে এয়ারপোর্টের বাইরে নামিয়ে দিল। সেখান থেকে জাল এয়ারলাইন্সের বুথ খুঁজে পেতে অসুবিধা হলোনা । বোর্ডিং পাস নিয়ে প্লেনে উঠে বসলাম। ওসাকা জাপানের দ্বিতীয় বড় শহর । প্রায় ২ কোটি লোকের বসবাস সেখানে। জাপানের অর্থনীতির অনেকটা হৃদপিণ্ড ওসাকা । প্লেন ছেড়ে দিল। রাতে প্লেনে ভ্রমণ খুব মজা লাগে। উপর থেকে নিচে টিমটিমে আলো ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনা । মাঝে মাঝে তাও দেখা যায়না !! ঘণ্টা খানেকের পরেই আমরা হেনাদা এয়ারপোর্টে নামলাম । 

তারপর ট্রেন আর ট্যাক্সির সাহায্য বাড়ি চলে এলাম। হিরোশিমা দেখার কষ্ট মিয়াজিমা আর কিয়োটো দেখে কিছুটা লাঘব হল। হিরোশিমা থেকে কিয়োটো যাবার পথে কোবে শহরের উপর দিয়ে গেলাম। ১৯৯৫ সালে এক ভয়াবহ ভুমিকম্পে কোবে শহরের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। প্রায় ৬০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল এবং ২ লাখেরও বেশী মানুষ গৃহহীন হয়েছিল। তারপর অবিশ্বাস্য ভাবে অতি দ্রুত তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল । বিশ্বের ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা । আমার কাছে মনে হয়েছে বড় ভুমিকম্পে কখনও যদি দেশটির বড় অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারপরেও তারা আবার ঘুরে দাঁড়াবে । জাপানীরা এমনই একটা জাতি। শ্রদ্ধা না করে কোন উপায় নেই। 

হিরোশিমা দেখে আসার পর খোশ মেজাজে ছিলাম। ছোটবেলায় যখন এসব পড়তাম কল্পনায় সেসব দেখতে পেতাম। সামনা সামনি দেখে একটা বড় শখ পূরণ হল । সেজন্য প্রথমত ধন্যবাদ জানাই মহান সৃষ্টিকর্তাকে । এরপরের ধন্যবাদ পাপ লু শুভ পেতেই পারে। পরের দিন আমাদের গন্তব্য ছিল টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় । সকালে উঠে তৃপ্তিকর নাস্তা করার পর ভাইবোন বের হলাম। ট্রেনে গেলাম। পাপলুর ল্যবে ঢুকতে হবে অবশ্যই ১০ টার মধ্যে। তারপর ল্যপটপে দিতে হবে ডিজিটাল ! হাজিরা। ১ সেকেন্ড দেরী হলেও ইয়েন কর্তন করা হবে। নিয়ম নিয়মই এবং সবার জন্য সমান। কেউ বেশী সুবিধা পাবেনা। কেউ না। আমরা ল্যবে ঢুকে দেখি আর ৫৯ সেকেন্ডের মধ্যে ল্যপটপে যেয়ে হাজিরা দিতে হবে। এদিকে ল্যপটপ আর ওপেন হয়না। দুজনেই টেনশনে পড়লাম । একেবারে শেষ মুহূর্তে ল্যপটপে যেয়ে হাজিরা দেয়া গেল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম । মাত্র ১৮ সেকেন্ড বাকী ছিল! তারপর ল্যবমেটদের সাথে পরিচয় করে দিল পাপলু । 

একজন মিশরীয় ছিল।আরও দুএকজন ছিল। সবাইকে খুব ভাল আর আন্তরিক মনে হল। সবাই সবার মতো কাজ করছে। একসাথে বসে আড্ডা বা পরচর্চা করছে না। পাপলুর এক ম্যডামের কাছে গেলাম। খুব হাসিখুশি আর অমায়িক ব্যবহার । চেহারাটাও খুব মিষ্টি । পাপলুকে খুব পছন্দ করে কথা বলে বুঝলাম। খুব নামকরা গবেষক । তাঁর অনেক আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। এরপর পাপলু নিয়ে গেল আরেক অধ্যাপকের কাছে। তিনি মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলেন। চেম্বার খুব ছিমছাম। প্রচুর বই। সেগুলো শুধু সাজিয়ে রাখার জন্য রাখা হয়নি । নিবিষ্ট মনে তিনি কাজ করেই যাচ্ছিলেন । হিরোশিমায় যদি সে মুহূর্তে অ্যাটম বোমাও পড়ে তবুও তার মনঃসংযোগে চিড় ধরবেনা ! আমাদের দেখে উঠে আসলেন। মিষ্টি করে হাসলেন । বিরক্ত হলেও বুঝতে দিলেন না। আমি ডাক্তার শুনে কথা বলতে বেশ আগ্রহী হলেন। জাপানে কি কি দেখেছি তার বিবরণ দিলাম। খুশি হলেন বলে মনে হল। আমি মেডিসিনে উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য পড়ছি শুনে তিনি আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। আমার নাদুস নুদুস গোলগাল চেহারা দেখে তিনি বলে উঠলেন , ‘ 

সবই ঠিক আছে , কিন্তু তোমার ডায়াবেটিস নেই তো! “কথাটা বলার সময় দুষ্টুমি মার্কা একটা হাসি দিলেন ! জাপানে আমার মেদভুঁড়ি কদাচিৎ চোখে পড়েছে । সবার হালকা পাতলা গড়ন এবং পোশাক পরিচ্ছদে ধোপদুরস্ত । চেহারার মধ্যে একধরণের সারল্য চোখে পড়ে । মানুষজনকে অনেক হাঁটতে হয় জাপানে । জাপানীদের গড় আয়ু পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী । পথেঘাটে ধূমপান করছে এমন একটা মানুষও আমার চোখে পড়েনি । জাপানি সেই অধ্যাপকের সাথে আলাপের পর এসে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করলাম। জেব্রা ফিশের মাংসপেশি থেকে DNA বের করলাম। যেসব মেশিনের ছবি দেখেছি বা ইউটিউবে ভিডিও দেখেছি সেসব দিয়ে নিজ হাতে এক্সপেরিমেন্ট করলাম। এত যন্ত্রপাতি সেখানে ! সবকিছু হাতের নাগালে পাওয়া যায় । গবেষণার অফুরন্ত সুযোগ সেখানে। ২০১৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার একজন জাপানি পেয়েছেন। যা অবস্থা দেখে আসলাম ভবিষ্যতে আরও অনেকে পাবে এটা বলে দেবার জন্য জ্যোতিষী হতে হয়না। কাজের মাঝে শেয়ার মার্কেট নিয়ে বা কোথায় টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে সেসব ভাবার দিকে তাঁদের ঝোঁক নেই। 

নিজেদের গবেষণাগারের দৈন্যদশা চোখের সামনে ভেসে উঠল । বিভিন্ন ধরণের মাইক্রোস্কোপ দেখলাম। একটি দেখলাম যেটিকে খুবই শক্তিশালী মনে হল। সেদিন ছিল শুক্রবার । এক্সপেরিমেন্ট সফল হল। নামাজ পড়ার জন্য বের হলাম। পাছে হারিয়ে যাই এই আশংকায় পাপলু সেই মিশরীয়কে সাথে যেতে অনুরোধ করলেন। দুজন গল্প করতে করতে মসজিদে গেলাম। লোকটি খুব ভদ্র এবং দারুণ দেখতে। মসজিদ প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। সেখানে যেয়ে দেখি একটা ঘরে কেউ পিয়ানো বাজাচ্ছে কেউ ভায়োলিন বাজাচ্ছে। তার পাশের ঘরেই নামাজের ব্যবস্থা। নামাজের ঘরে ঢুকেই দেখি কোন বাইরের আওয়াজ ভেতরে আসছে না। ওজু করলাম। সেদিন খুব ঠাণ্ডা ছিল। তারপর খুৎবা শুনতে বসলাম । চমৎকার খুৎবা । ইংরাজিতে বলছেন। সুন্দর বোঝা যাচ্ছে । ভরাট কণ্ঠ । বলার ভঙ্গিটা এত সুন্দর কেবল শুনতে ইচ্ছে করে। নামাজ শুরু হবার সাথে সাথে গোটা ঘর ভরে গেল। বিভিন্ন দেশ থেকে সবাই এসেছেন। 

মোনাজাত করে বের হয়ে এলাম। মিশরীয় ভাই এর সাথে গল্প করতে করতে ফিরে এলাম। তিনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। মিশরীয় রাজনীতি , পিরামিড ,শিক্ষাব্যবস্থা ,ডাক্তার সব বিষয় নিয়েই কথা হল। সেখানে ডাক্তারের অবস্থা বেশ ভাল। সবাই তাদের সম্মান করে। জাপানে ডাক্তারের কেমন কদর সে বিষয়ে পরে একটা গল্প বলব । সে মিসরীয় ভাইয়ের বাবা মা খুব ধার্মিক । এমনকি জাপান পর্যন্ত বেড়াতে আসতে তারা রাজী না। যেহেতু জাপানে এলকোহল বিক্রি হয় আর মেয়েরা পর্দা করেনা তাই তারা আসবেন না! সেখান থেকে ফিরে দিকে পাপলুর সাথে আরেক বাঙালি মেয়ে গল্প করছে। সদ্য জাপানে এসেছেন তিনি। বাংলাদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক । তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে ভাইবোন আবার বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে এক ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁতে গেলাম। শিক কাবাব , নান রুটি আর চিকেন খেলাম। সুস্বাদু কিন্তু খুব ঝাল। পাপলু আবার ঘড়ি ফেলে এসেছিল। আবার হাঁটতে হাঁটতে যেয়ে নিয়ে আসল । 

এরপর ঠিক করলাম আখিয়াবারা তে যাব । ইলেকট্রনিক্স জিনিসের আখড়া । এমন কিছু নেই যা সেখানে নেই। যারা ইলেকট্রনিক্স জিনিস পছন্দ করেন তারা এখানে আসলে ব্যপক খুশি হবেন নির্দ্বিধায় বলা যায় । বড় বড় সোফা আছে সেখানে যেগুলো ম্যসাজ করে দেয়। দাম প্রায় তিন চার লাখ টাকা । বেশ কয়েকটা স্যম্পল হিসেবে রাখা আছে। ম্যসাজ নেয়ার সময় আরামে চোখ বন্ধ হয়ে গেল! সব ক্লান্তি কোথায় চলে গেল কে জানে। পাপলু জাপান রেডিওতে পার্টটাইম জব করে। ও চলে গেল। আমাকে একটা ট্রেনে তুলে দিল। নির্দেশনা দিয়ে দিল। এমন একটা কামরায় তুলে দিল যেখান থেকে নামলে সরাসরি লিফট পাব। নেমে ঠিক সেখানেই লিফট পেলাম। একটু আগে বা পরে না। কি চমৎকার ব্যবস্থা। লিফট থেকে নেমে হাটতে হাঁটতে বাড়ী চলে এলাম......

জাপানে থাকার সময় ফুরিয়ে আসছিল। ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। বাসার কথা মনে পড়ত খুব। মনে হত সবাইকে নিয়ে যদি চলে আসতে পারতাম ! আর ২ -৩ দিন হাতে ছিল। প্ল্যান ছিল মাউন্ট ফুজি দেখতে যাব । গাড়ি ভাড়া করে সাড়ে তিন মাস্কেটিয়ার রওনা দিলাম। আমরা এমন একটা জায়গায় যাব ঠিক করলাম যেখান থেকে ফুজি পাহাড় , আশি লেক আর জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি তিনটাই দেখা যাবে। সেদিন ছিল শনিবার। সহনীয় জ্যাম ছিল। সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে বেরিয়ে পড়লাম। শুভ ড্রাইভ করল। একটার পর একটা টানেল পার হতে থাকলাম। পাহাড়ের নীচ দিয়ে টানেল । খাসা ব্যবস্থা। যাবার পথে কাওয়াসাকি শহরের উপর দিয়ে গেলাম। কাওয়াসাকি ডিজিজ বলে একটা অসুখ আছে। সে বিষয়ে বাংলায় আমার একটা লেখাও আছে। তাই ভাল লেগে গেল। আরও ভাল লাগা শুরু হল যখন দূর থেকে পাহাড় দেখতে পেলাম। ২০০৩-২০০৪ এর দিকে আমরা কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের পক্ষ থেকে ট্যুরে গিয়েছিলাম। 

সিলেটে পাহাড় যারা দেখেছেন তারা জানেন অনেক দূর থেকে পাহাড় দেখা যায় । গাড়ি আগাতে থাকে আর মনে হয় পাহাড় পেছাতে থাকে। এখানেও সে একই অনুভূতি হল। সবুজ পাহাড় , স্পীডে গাড়ি চলছে আর পাশ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে । এর চেয়ে সুখের অনুভূতি আর কি হতে পারে? ভাল লাগছিল সব কিছু। তারপর আস্তে আস্তে পাহাড়ে উঠতে থাকলাম। শুভ দুর্দান্ত ড্রাইভ করল। তারপর আমরা এমন একটা জায়গায় এসে থামলাম যেখান থেকে ফেরীতে করে লেকে ঘোরা যাবে আবার কেবল কার দিয়ে পাহাড়ে যাওয়া যাবে । ফেরী ভ্রমণ ঠিক করা হল কিন্তু টিকিট পেতে ঘণ্টা খানেক সময় লাগবে। তাই কেবল কার দিয়ে পাহাড়ে উঠতে থাকলাম। ছুটির দিন। অনেক ভিড় ছিল। তারপরেও ভাল লাগছিল। বিভিন্ন দেশের পর্যটক চোখে পড়ল । কেবল কার দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম তখন মাউন্ট ফুজি চোখে পড়ল । এত সুন্দর পাহাড় পৃথিবীতে আছে?? একটা কথাই মন থেকে বের হয়ে এল , আলহামদুলিল্লাহ্ । এটি একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। জাপানের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় । মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকলাম। এই মুগ্ধতা হয়তোবা কোন দিনই শেষ হবেনা। প্রায় ৪ হাজার মিটার উঁচু । আমি দার্জিলিঙের পাহাড় দেখেছি। সেটার রূপ অন্য রকম। কিন্তু পুরো সাদা পাহাড় এই প্রথম দেখলাম। আকৃতিটা এত সুন্দর চোখে প্রশান্তি এনে দেয়। 

তারপর কেবল কারে পাহাড়ে পৌঁছালাম। যেয়ে দেখি তুষারে ছেয়ে আছে চারিদিক। উফ! এত সুন্দর । বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। জীবনানন্দ দাশ খুব সম্ভবত তুষার দেখেননি । দেখলে হয়ত আমরা অনবদ্য কিছু কবিতা পেতাম। যাই হোক ওয়াকুদানি উপত্যকায় চলে গেলাম। সেখানে দেখি সালফারের ধোঁয়া বের হচ্ছে। গরম পানির ঝর্ণাও আছে সেখানে। সেই পানি দিয়ে ডিম সিদ্ধ করা হয়। ডিমের খোলটা কালো রঙয়ের । সালফারের গন্ধও পাওয়া যায় । কথিত আছে সেই ডিম খেলে আয়ু বাড়ে । খেলাম কয়েকটা । খুব বেশী অন্যরকম কিছু মনে হলোনা। আয়ু বাড়ল কিনা কে জানে? তারপর ঘুরে বেড়াতে থাকলাম। ফাইজান কুন অসম্ভব সাহায্য করল। এই ধরণের বাচ্চা নিয়ে ঘুরেও মজা। কোন ঝামেলা বা উৎপাত করেনা। তারপর আমরা এমন একটা যায়গায় দাঁড়ালাম যেখান থেকে ফুজি পাহাড় খুব সুন্দর দেখা যায় । অনেকক্ষণ সেখানে থাকলাম। মনের আনন্দ যেন শেষই হতে চায়না। কিন্তু সারাদিন তো আর সেখানে থাকা যাবেনা তাই আবার কেবল কারে চড়ে নিচে নেমে আসলাম। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল । ঠাণ্ডাও ছিল খুব। 

পাহাড়ে উঠার সময় রাস্তার দুই পাশে তুষার দেখেছিলাম। হাত দিয়েও ধরেছিলাম জীবনে প্রথমবারের মতো । তবে মনে হয় শেষবারের মতো না। তারপর আবার পাহাড় থেকে নামতে থাকলাম। অন্ধকার হয়ে আসছিল। নামার সময় তেমন কোন গাড়ি চোখে পড়ছিল না। খুব নির্জন । একটু ভয়ই লাগছিল। আল্লাহ্র রহমতে সমস্যা হয়নি। পাকিস্তানি একটা রেস্তোরাঁতে খাওয়ার কথা ছিল । সময় স্বল্পতায় যাওয়া হলোনা। গাড়ি নিয়ে গিনযায় চলে এলাম। গিনযা খুব অভিজাত এলাকা। শপিং আর খাবারের জন্য বিখ্যাত । বিশ্ববিখ্যাত প্রায় সব বড় ব্র্যান্ড এর শাখা আছে এখানে। খান কাবাব ঘরে খেলাম। কলকাতার এক বাঙালি ওয়েটার ছিল সেখানে। আমাদের দেখে খুব খুশি হল । স্যুপ , নান আর শিক কাবাব খেলাম। খুব ভাল লাগল । তবে ঝাল ছিল বেশী ।রেস্তোরাঁতে অনেক ভিড় চোখে পড়ল । সবাই ঝাল খাচ্ছে আর মুগ্ধ হচ্ছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে । তারপর গাড়ি করে বাসায় ফিরলাম। মনে রাখার মত একটা দিন কাটল । জাপান স্থাপত্যশৈলী তে যেমন উন্নত তেমন তার প্রাকৃতিক দৃশ্য । যে দেখবে মুগ্ধ সে হবেই........

ফুজি পাহাড় দেখে আসার পরদিন সকালটা বাসাতেই কাটালাম । চমৎকার আড্ডা হল । পরিবার,সমাজ,দেশ,বিদেশ সবকিছু নিয়েই আলোচনা হল । বিদেশে যারা থাকেন তারা দেশের এই প্রাণবন্ত আড্ডা ভয়ানকভাবে মিস করেন। যদিও আমদের দেশে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যা হয় তা হচ্ছে পরচর্চা আর বিদ্বেষমূলক আড্ডা । তবে ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। দুপুরে বাইরে খাওয়া দাওয়া করব ঠিক হল । সেই ম্যনহাটন ফিশে । তারপর বের হলাম সবাই। এবার বাসে গেলাম। ইকেবুকরো তে। বাসগুলি চমৎকার। একটা বিষয় দেখলাম কেউ বাসে উঠেই বসার জন্য উৎপাত শুরু করেনা। বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা কেউ বসার জন্য এদিক ওদিক তাকান না। হাতল ধরে নিরবিকারভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। ট্রেনে এক হাতে হাতল আর অন্য হাতে স্মার্ট ফোন । অন্যজন কি করছে সেদিকে কারো আগ্রহ নেই। মেয়েরাও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছে। অন্য কেউ ধাক্কা দেবার কথা চিন্তাও করছেনা। মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত সবাই।মেয়েরা কেউ এদিক ওদিক তাকিয়ে মিষ্টি রহস্যময় হাসি দিচ্ছেনা! ম্যনহাটন ফিশে খেতে বসলাম । সেই স্বাদ খাবারের। পাপলু একটার পর একটা মাছ তুলে দিতে থাকল । 

শুভ আড়চোখে ভাই বোনের এই ভালবাসা দেখতে থাকল। খাওয়া দাওয়ার পর আমরা বের হলাম। শপিং মলে চলে গেলাম। সব কিছু সুন্দরভাবে সাজান। চোখ ধাঁধান আলো । সবার জন্য কিছু কিছু কেনা হল । গোল বাধল আনিশার হেলিকপ্টার নিয়ে। আমার কেনার ব্যপারে অতিরিক্ত আগ্রহী । ওকে রাজশাহীতে আমি একটা কিনে দিয়েছিলাম। ছাদে উড়াতে যেয়ে চারতলা থেকে সেটি পড়ে যায় । আনিশা কান্নাকাটি করতে থাকলে ওকে নিয়ে অনেক দূর ঘুরে অকুস্থলে যাই । যেয়ে দেখি হেলিকপ্টারটি অক্ষতভাবে পড়ে আছে। তখন আনিশা যে পরিমাণ খুশি হয়েছিল আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সৎ পয়সায় কেনা ছিল বোধহয় ! হেলিকপ্টারটি খুব ভালবাসত আনিশা। পরে অবশ্য তার বিভিন্ন অংশ আমি ঘরের বিভিন্ন স্থানে আবিস্কার করেছিলাম। সেটির জন্য যে আনিশাই দায়ী এটা বোঝার জন্য শারলক হোমস হতে হয়না। যাই হোক পাপলু নানাভাবে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। এমনকি ওয়েভ সংক্রান্ত নতুন নতুন তথ্য দিতে থাকে। আমি বিভ্রান্ত হইনা। কারণ টেক্সট বইতে সেসব নেই। হয়ত কোন ইম্প্যকট ফ্যকটর বিহীন জার্নালে পেয়েছে! যাই হোক অবশেষে শুভর মধ্যস্থতায় কেনা হল। দেশে এসে সেটি সুন্দরভাবে উড়েছে ওয়েভ সঙ্ক্রান্ত কোন জটিলতায় পড়েনি । 

সিভিল এভিয়েশনের রাডারেও ধরা পড়েনি । তারপর রুবেলের ছেলের জন্য একটা গিফট কেনা হল। পরেরদিন লাগেজ গোছানোর সময় সেটি আর পাওয়া গেলনা। পাপলুর ধারণা হল আমার হেলিকপ্টার কেনার জন্যেই এমনটি হয়েছে। আসলে অনেক রাত হয়েছিল সেদিন। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আমরা ফেলে এসেছিলাম। পরে অবশ্য পেয়েওছিলাম । অদ্ভুত দেশ! এত সৎ বলেই তারা আজ বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ হিসেবে পরিগণিত । রাতে আমাকে টিপিক্যাল জাপানি ফুড খাওয়ানোর চেষ্টা করা হল । মৃদু আপত্তি করছিলাম। দুইজনের জোরাজুরিতে খেতে হল। অবাক বিস্ময়ে খেলাম। স্যুপটাই খাওয়া হল ।অন্য কিছু খেয়ে তেমন শান্তি পেলাম না। সুশি খাওয়া হলোনা। মাছের উপর সস দিয়ে কেমনে খাওয়া যায় !! অথচ সুশির জন্য জাপান বিখ্যাত । তারপর আমরা সবাই বাসায় আসলাম। লাগেজ আধাআধি গোছান হল। পাপলুরা আমেরিকায় চলে যাবে। অনেক দিনের সংসার তাদের। 

কত কিছু যে ফেলে দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। আমি কিছু আনতে পেরেছিলাম। কিন্তু অনেক মুল্যবান জিনিস তাদের ফেলে দিতে হয়েছে। খুব সুন্দর বাসা ছিল। আমার থেকে খুব ভাল লেগেছে যদিও টোকিওর মাঝে হবার কারণে ভাড়া অনেক বেশী । আমি আবার যেখানেই যাই না কেন মায়া বসে যায় । এবারেও ব্যতিক্রম হলোনা। বরং অন্য জায়গা থেকে জাপানে মায়া বেশী বসেছে। বেঁচে থাকলে নিশ্চয় অন্য অনেক দেশে যাওয়া হবে । কিন্তু জাপানের মতো অন্য কোথাও এত ভাল লাগবে কিনা আমি নিশ্চিত না। ফেরার লম্বা জার্নির কথা ভেবে কিছুটা উৎকণ্ঠিত ছিলাম কিন্তু যে মায়ায় আচ্ছন্ন ছিলাম তাতে উৎকণ্ঠা কমে যাচ্ছিল...মনে হচ্ছিল আর মাত্র ২ দিন পরেই আমার আবার ইবনে বতুতার মতো যাত্রা শুরু হবে..................।

আর মাত্র ১ দিন বাকী । তারপর ছেড়ে আসতে হবে জাপান। গভীর মমতায় ভালবেসে ফেললাম এশিয়ার শ্রেষ্ঠ দেশটিকে । বুকের ভেতর হারানোর বেদনা অনুভব করলাম। পাপলু শুভ আর ফাইজানের জন্য কষ্ট হচ্ছিল। আমার জন্যে এই তিনজন যা করেছে কোন তুলনাই নেই। পৃথিবীর সব বোনরাই ভাইদের ভালবাসে এতে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের বন্ধনটা বোধকরি কিছুটা অন্যরকম। অনেক প্রেশার মাথায় নিয়ে তারা আমাকে প্রচুর সময় দিয়েছে। দীর্ঘদিনের সংসারের সব জিনিসপত্র ফেলে যেতে হবে আমেরিকায়। বাসায় কত কাজ। অফিসে কত কাজ। সব ফেলে রেখে আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ...আমি অভিভুত। কিছুটা ক্ষমাপ্রার্থী তাদের কাছে। আসার আগের দিনটা বাসাতেই কাটালাম । দূরে কোথাও যাইনি । আমি যে স্যরের সাথে আর্সেনিকের কাজ করি তিনি কিছু মূল্যবান জিনিস আনতে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি মেশিন ছিল যার মুল্য প্রায় ১০ লাখের কাছাকাছি। কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। চীনে ফেরার সময় যেহেতু একরাত থাকতে হবে তাই চীনের কাস্টমস নিয়ে কিছুটা টেনশন হচ্ছিল। স্যারের এক ছাত্র এবং কলিগ জিনিসপত্র দিতে এলেন। 

তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক । চমৎকার দিলখোলা মানুষ । হাসিখুশি । ষ্টেশনের কাছাকাছি এক জায়গায় দেখা করব ঠিক করলাম। যেয়ে দেখি মনের সুখে বিড়ি টানছেন । সুখটান দিতেও দেখলাম। কাছে গিয়ে সবকিছু বুঝে নিয়ে গল্প শুরু হল । কফি কিনলাম। হাতে ছিল কফির কাপ। খুব ঠাণ্ডা বাইরে। সেই যে আড্ডা শুরু হল আর শেষ হয়না। ভাইয়াকে দেখেই আমি প্রথম জাপানে কাউকে বিড়ি খেতে দেখলাম। আর কোথাও চোখে পড়েনি । সিগারেটের মোথাও দেখিনি কোথাও । বিদেশে দুই বাঙালি বিশেষ করে যাদের মনের মিল আছে তারা একত্রিত হলে দিনরাত একত্রিত হয়ে যায় । এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলোনা । 

আড্ডা যেন আর শেষই হতে চায়না। ভাইয়াকে বললাম , সিগারেট খাচ্ছেন ,ধরতে পারলে তো জরিমানা করবে। ভাইয়া বললেন ,ধরলে ২০০০ ইয়েন দিয়ে দিব ,সমস্যা নেই। এই ধরণের মানুষের সাথে গল্প জম্বেনা তো কার সাথে জমবে ? আগে জানতাম পান খাওয়া লোকেরা সদালাপী হয় এখন আমার মনে হয় বিড়ি খাওয়া লোকেরাও সদালাপী হয়। যেহেতু লাগেজ গোছানোর ব্যপার ছিল তাই ঘণ্টা দুয়েকের ভেতরেই ফিরে আসলাম। রুবেলের ছেলের জামা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। গতকাল আমরা ফেরার পথে এক দোকানে বাজার করেছিলাম।আমার মনে হচ্ছে সেখানেই আমি রেখে এসেছি। গেলাম সেখানে। বিরক্ত তো হলই না উল্টা খুব ভাল ব্যবহার করল। গতকাল যেসব হারানো জিনিস তারা পেয়েছে সেগুলো একজায়গায় যত্ন করে রাখা। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল সেখানে। দেখি সেখানেও নেই। আমি আর কি মন খারাপ করব। তাদেরকেই বেশী কষ্ট পেতে দেখলাম! আমাদের দেশে এমনটি কি কখনো হবেনা?? সেখান থেকে একা একা ষ্টেশনে গেলাম। 

তাদেরকে ব্যপারটা বললাম।তারাও মোবাইল নম্বর লিখে রাখল। পেলে জানাবে। রাতে শুভ দেখি সেই জামা নিয়ে এসে হাজির। শুভ শপিং মলে ফোন দিয়েছিল। তারা বলেছে জামা সেখানেই আছে। একটা মানুষ বা জাতি সৎ না হলে কখনই উপরে উঠতে পারেনা বা পারলেও বেশীদিন টিকতে পারেনা। ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে একজনকে পুলিশ ষ্টেশন কোনদিকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি এমনভাবে নির্দেশনা দিলেন মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না ঠিকমত । মনে হল তিনি সাথে করে নিয়ে যাবেন । ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম। ঢাকায় প্রায়ই যাওয়া হয়। ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলে বেশীরভাগই খুব বিরক্ত হন। আরেকদিক তাকিয়ে কানের খৈল পরিষ্কার করতে থাকেন। এমনভাবে তাকান যেন ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে খুব বড় অপরাধ করা হয়েছে। কেউ কেউ ব্যস্ততার ভান করেন। কিন্তু কিসের ব্যস্ততা তা হয়ত নিজেও জানেন না! বাসায় ফিরে আবার চিংড়ী আর স্যমন মাছ দিয়ে ভাত খেলাম। আয়োজন অনেক ছিল। দুপুরে একটু ঘুমালাম। 

বিকেলে আবার সেই ভাই ফোন দিলেন। আরও কিছু দিবেন সাথে। আনতে গেলাম। কফি আর আড্ডা আবার শুরু হল। রাত ১১-৩০ পর্যন্ত আড্ডা হল। আমার পরেরদিন ফ্লাইট । জাপানে ডাক্তারদের যে কত সম্মান তার একটা গল্প বললেন। একবার এক লোক এক্সিডেন্ট করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। যায় যায় অবস্থা। ডাক্তাররা প্রানপ্রণ চেষ্টা করছেন। রোগীর এখন তখন অবস্থা। পরিবারকে খবর দেয়া হয়েছে। মা এসেছেন। সেই মুহূর্তে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে কিছু ইঞ্জেকশন দেয়া হল। তার পরপরই লোকটা মারা গেল। মা শুধু কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তারের হাত ধরে বলল , আপনি অনেক করেছেন। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করবে। আমি কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি। এই হচ্ছে তাদের ডাক্তারের সাথে ব্যবহার । অথচ আমাদের দেশে এমন ঘটলে বলা হত ভুল ! চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। যিনি বলতেন তিনি চিকিতসাবিদ্যা অধ্যয়ন তো দূরে থাক চিকিৎসার মৌলিক বিষয়গুলোই জানেন না। কিন্তু এ ধরণের কথা বলে শুধু শুধু মানুষকে উত্তেজিত করেন। রাতের মধ্যেই লাগেজ সব গুছিয়ে নিলাম। রাতে শেষবারের মত জাপানে খেলাম। কিন্তু যত ভাল লেগেছে আমার বেঁচে থাকলে ইনশাআল্লাহ আবার যাব । খুব তাড়াতাড়িই হয়তোবা যাব ..................

সকালেই ঘুম ভাঙল । বিষণ্ণ সকাল। জাপানের শেষ সকাল। মনে হল একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলাম। হঠাৎ করেই ভেঙ্গে গেল। কোন মানুষের জীবনেই একটানা আনন্দের দিন বোধহয় বেশীদিন থাকেনা। আমার ক্ষেত্রে কেন ব্যতিক্রম হবে? এয়ারপোর্টে পাপলু গেলনা। ফাইজান ঘুমাচ্ছিল। ওকে রেখে যাওয়া সম্ভব ছিলনা। চোখের কোণে বোধহয় পানি দেখেছিলাম। এয়ারপোর্ট যেতে বাসা থেকে আড়াই ঘণ্টার মতো সময় লাগে। আমরা বের হলাম। খুব ঠাণ্ডা বাইরে। কোন ট্যাক্সি পেলাম না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। হাল্কা টেনশন হচ্ছিল। শুভ দেখি মোবাইলে কি জানি করছে। একটু পর বলল দশ মিনিট পর ট্যাক্সি আসবে। ঠিক দশ মিনিট পর ট্যাক্সি আসল । ড্রাইভার সাহেব খুব আন্তরিক। লাগেজ ছিল ৪১ কেজি। একটা ট্রলি আর একটা উদ্ভট টাইপের লাগেজ। ধরাও কষ্ট আবার টানাও কষ্ট । 

শুভ সেই লাগেজ আমাকে একবারও টানতে দেয়নি। অস্বাভাবিক দক্ষতায় তোলা হল। তারপর আমাদের ষ্টেশনে কিছুক্ষণ পরে নামিয়ে দিল। ট্রেনে উঠলাম । শিনকানসেন এর ভাই। ছেড়ে দিল। পেছনে ফেলে এলাম সুন্দর ছিমছাম ছবির মতো শহর । ভাগ্য বলে তো একটা ব্যপার আছে কিন্তু এমন শহর গড়তে দরকার পরিকল্পনা ও সবার চেষ্টা । একজন দুজনের চেষ্টায় এটা সম্ভব না। জাপানের লোকসংখ্যা অনেক । বার কোটিরও কিছু বেশী । দেশ যে খুব বড় তাও নয়।বাংলাদেশের প্রায় ৩ গুণ । কিন্তু রাস্তাঘাটে তেমন লোকজন চোখে পড়েনা । সুন্দর সিস্টেমে সবই সম্ভব। ট্রেন এসে নারিতা এয়ারপোর্টে থামল । সময় হাতে ছিল দেড় ঘণ্টার মতো । শুভ নাস্তা খাওয়াবেই। আমি খেতে চাচ্ছিলাম না। কেন জানি কিছু খেতে ভাল লাগছিলনা। হয়ত মন খারাপ ছিল তাই।লাগেজ দিয়ে বোর্ডিং পাস নিলাম। সাংহাইতে লাগেজ নামাতে হবেনা সরাসরি বেইজিং এ নিলেই হবে। একদিন পরে হলে আমি ঢাকায় লাগেজ নিতে পারতাম। 

শুভর জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত খেতেই হল। সুস্বাদু খাবার। তারপর ইমিগ্রেশনে চলে গেলাম। শুভকে যতদূর পর্যন্ত যাওয়া যায় ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। কোলাকুলি পর্ব শেষ করে আস্তে আস্তে হাঁটা দিলাম। শুভ বলল , আপনি ইমিগ্রেশন ক্রস না করা পর্যন্ত আমি দাঁড়িয়ে থাকব। ঘণ্টা খানেক সময় বাকী ছিল। আমি জানি শেষ সময় পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবেই। যদি ভূমিকম্প হয় তাও। এতোটা নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত ছেলে সে। এ কারণে সবাই তাকে ভালবাসে । এমন না হলে সবার ভালবাসা কখনো পাওয়া যায়না । চিন্তাভাবনা সৎ ও স্বচ্ছ । আল্লাহ্ অনেক বড় করেছে এবং আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আরও অনেক ভাল করবে শুভ। চোখ ছলছল করছিল আমার। সবাইকে রেখে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। পৃথিবীতে এত মায়া কেন?? কেন এত ভালবাসা ? ইমিগ্রেশন পার হতে ১ মিনিটেরও কম সময় লাগল । এত আধুনিক তাদের ব্যবস্থা। তারপর চেকিং হল। সেখানেও সময় লাগল না। বোর্ডিং পাসে গেট নম্বর ছিল। 

হাঁটতে হাঁটতে সেই গেটে চলে গেলাম। অনেক হাঁটতে হল। প্লেনের সময় হল। উঠে বসলাম । আনিশাকে দেখতে পাব , নাহরিন কে দেখতে পাব, বাবা মাকে দেখতে পাব। আনন্দ তো হচ্ছিলই । কিন্তু মনের ভেতরটা গুমোট হয়ে ছিল। প্লেন ছাড়ল । বেশী বড় না। তবে সাংহাই থেকে যে বিমানে নারিতা এসেছিলাম সেটি মোটামুটি বড় ছিল। শেষবারের মত মায়াবী জাপানকে আকাশ থেকে দেখলাম। জাপানের বিভিন্ন টুকরো টুকরো ঘটনা মনে আসছিল। ঘুম এসে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখি আরও ২ ঘণ্টা সময় লাগবে। জানালার পাশে সিট পড়েছিল । বাইরে তাকিয়ে থাকলাম। নাস্তা দিয়ে গেল। খেতে পারলাম না। শুধু পাউরুটি বাটার খেলাম। 

চা খেলাম। বিভিন্ন ধরণের জ্যুস পাওয়া যাচ্ছিল । সেগুলো ভাল লাগল । তারপর সাং হাই বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। ইমিগ্রেশন হল। এক বাংলাদেশী ভাই ও ভাবীর সাথে পরিচিত হলাম। ১ বছর হল বিয়ে হয়েছে তাদের। হাসিখুশি । মামার কাছে বেড়াতে গিয়েছিল। তাদেরও জাপান খুব ভাল লেগেছে। সাংহাইতে বেশীক্ষণ থাকতে হয়নি। একটু পর বেইজিং এর প্লেনে উঠে বসলাম। বেইজিং এ যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাতে থাকতে হবে। যেহেতু সাহসী সঙ্গী সাথী ছিলনা তাই চীনের ভেতরটা তেমনভাবে ঘোরা হবেনা বুঝে ফেললাম । এয়ারপোর্টেই হোটেল ঠিক করে ফেললাম। হোটেলটার নাম ঠিক মনে নেই। এয়ারপোর্টের কাছেই। ৫ কিলোমিটার এর মধ্যেই । খুব ঠাণ্ডা ছিল সেদিন। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই টের পেলাম। হোটেলের দিকে ধীরে ধীরে যেতে থাকলাম।

চীনে একরাত থাকতে হল। থাকতে যে হবে টিকিট কাটার সময়েই বুঝেছিলাম। এয়ারপোর্টেই বুকিং করা যায় হোটেলের । আমাদের থেকে যে ১০০ ইউয়ান বেশী নিল হাবভাব দেখেই বুঝলাম। আমরা বলছি কারণ আমার সাথে সেই বাংলাদেশী কাপল ছিল। এয়ারপোর্টেই খাবার কিনলাম। চীন ও জাপানে বেশীর ভাগ খাবারেই পর্ক দেয়া থাকে। সাবধানে অনেক পড়ে তারপর কিনলাম। বেশীরভাগ আবার চাইনিজ ভাষায় লেখা। ভাইয়ারা একটা পাউরুটি টাইপের খাবার কিনে নিজেরা খেল ।আমিও একটু ভাগ পেলাম । এরকম অদ্ভুত ধরণের বিশ্রী খাবার আমি জীবনেও খাইনি। সেই যে বমিভাব হল প্রতিজ্ঞা করলাম ২ রাত আর কিছুই খাবনা !!তারপর একটা কিম্ভূতকিমাকার বাহনে চড়ে হোটেলের দিকে গেলাম। বাহন বলছি কারণ সেটা মাইক্রো বাস বললে কম বলা হয় আর বাস বললে বেশী বলা হয়। 

রাতে যেহেতু যাচ্ছিলাম তাই ভাল করে তেমন কিছু দেখতে পাইনি। বলেছিল ৫ মিনিট । লাগল ২০ মিনিট । হোটেলের কাউনটারে একটি মেয়ে বসা ছিল। সুন্দরী বলা চলে। তিনি একাই দেখি সব কাজকর্ম করছেন। সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে একতলায় রুম পেলাম। অনেক বড় রুম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভাড়া নিল ৩২০০ টাকা । সস্তা বলা চলে! পরের দিন সকাল ৮ টায় ফ্লাইট । ৬ টার মধ্যেই বলে রেখেছিলাম যেন ডেকে দেয়। পাশের রুমে সেই ভাইরা থাকল । খুব ক্ষুধা লেগেছিল। প্লেনে তেমন কিছু খেতে পারিনি। কিন্তু প্রতিজ্ঞা তো আর ভাঙ্গা যায়না !! কি আর করা উসখুস করেই কাটিয়ে দিলাম। পানি খেলাম বেশী করে। ২ ইউয়ান লাগল । ১ ইউয়ান মানে ১৩-১৪ টাকা । হিগাশি জুজু ,অজি কামিয়া , অজি, নাম্বুকু লাইন, কেইন তহুকু লাইন , হিরোশিমা ,মিয়াজিমা, টোকিও , পাপলু, ফাইজান, শুভ, আনিশা, নাহারিন,বাব মা সবার কথাই খুব মনে পড়ছিল । রাত ৮ টায় ঘুম আসার কথা না। চাইনিজ টিভি দেখলাম। কি যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। এমন দুর্বোধ্য ভাষা । ইন্টারনেট আছে কিন্তু ফেসবুক নেই। শুভকে মেইল করে জানালাম ভাল আছি। কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পাইনি। উঠে দেখি ১১ টা বাজে। সারাদিন তেমন কিছুই খাইনি। প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হল। 

মানুষ প্রতিজ্ঞা করেই প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গার জন্য। পানি খেয়ে আর কতক্ষণ থাকা যায় । ইবনে বতুতা আর মার্কা পোলোর কথা মনে হল। তারা তো অবর্ণনীয় কষ্ট করেছেন। সেই তুলনায় আমি তেমন কষ্টই করিনি। তারপর বের হয়ে হোটেল লবিতে পায়চারী শুরু করলাম। কাউনটারের সেই মেয়েটি দেখে অসম্ভব দক্ষতায় কাজ করেই যাচ্ছে । এয়ারপোর্টেই কাছেই হোটেল। লোকজন অনবরত আসছে আর যাচ্ছে । কাউনটারের অপর পাশে একটা স্ন্যক্স এর দোকান ছিল। সেখানে এক মহিলা বসে আছেন। খুব শীত ছিল সেদিন। কম্বল গায়ে দিয়ে বসে আছেন এবং সারারাত বসে থাকবেন। সবাই কাজ করছে। কোন ক্লান্তি নেই। আর আমাদের দেশের অনেকেই এই সময় গ্যাস আর ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর আয়োজন করছে। আসলে পরিশ্রম ছাড়া জীবনে যে কিছুই পাওয়া যায়না এই বোধটাই আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। কেউ পরিশ্রম করে বড় হয়ে গেলে তাকে আবার টেনে নামানোর চেষ্টাতে কমতি নেই। মন খারাপ হয়ে গেল।

বিস্কিট আর পানি কিনে নিয়ে আসলাম। ঘুমাতে ইচ্ছা করছিল না। ভাবলাম যদি ডেকে না দেয়, যদি প্লেন ছেড়ে চলে যায় !! চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। কখন ঘুমালাম মনে নেই। উঠে দেখি ৪ টার মতো বাজে। আর ঘুমালাম না। রেডি হয়ে সাড়ে ৫ টার দিকে কাউনটারে গেলাম। অবাক হওয়ার পালা। দেখি সেই মেয়েটি তখনো সেখানে। এত শক্তি আর ধৈর্য কোথা থেকে পায়!! আগের দিনে বাহনে যে লোকটিকে দেখেছিলাম তাকে আবার দেখলাম। গোলগাল গাট্টা গোটটা চেহারা। সারাদিন কাজ করতে দিলেও পারবে বলে মনে হল। আমাদের মনে হয় সব চীনা আর জাপানির চেহারা এক। আসলে তা নয়। খেয়াল করলে পার্থক্য ধরা পড়ে । সবাই আবার গাড়ীতে চড়ে এয়ারপোর্টে গেলাম। ঠাণ্ডায় তখন বেইজিং কাতর।আমরাও। এয়ারপোর্টে ঢুকে বোর্ডিং পাস নিলাম। লাগেজ আর কুনমিং এ নামাতে হবেনা। ঢাকাতে নিলেই হবে। বস্তার মত সেই অদ্ভুত লাগেজ টানতে খুব কষ্ট হল। শুভ তো আর নেই। একাই টানলাম । সেই ভাই কিছুটা সাহায্য করলেন। ইমিগ্রেশন আর চেকিং এর পর গেটে গিয়ে বসলাম। কিছু খাবার কিনলাম। হালাল অবশ্যই । তারপর প্লেনে উঠে বসলাম । 

কুনমিং যেতে ২ ঘণ্টার কিছু বেশী সময় লাগল । নামতেই দেখি এক মহিলা ডা ...কা ডা ...কা বলে চিৎকার করছে। ঢাকার গন্ধ পাওয়া শুরু করলাম। মনে হল মহাখালীতে দাঁড়িয়ে আছি আর লোকাল বাসের হেল্পার চিৎকার করছে। তবে সেদিনের সেই অদ্ভুত চিৎকারেও কিন্তু খারাপ লাগেনি। আনন্দ পেয়েছিলাম। বাসায় ফেরার আনন্দ। যত সমস্যাই থাকুক না কেন দেশ তো আমার। জাপান চীন যতই উন্নতি করুক সেটা তো আমার দেশ নয়। তাছাড়া আমাদের দেশেও অনেক অনেক ভাল মানুষ আছে। অনেক সম্ভাবনা আছে। শেষবারের মত ইমিগ্রেশন ক্রস করলাম। যখন কুনমিং থেকে প্লেনে উঠলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে তখন যেন পৃথিবীর সব আনন্দ এসে ভর করল। অদ্ভুত সেই অনুভূতি । ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে । আর মাত্র ২ ঘণ্টা । ১২০ মিনিট । আপেক্ষিকতার সূত্র অনুযায়ী সময় দীর্ঘ হতে শুরু হল ! হঠাৎ দেখি কুন মিং এর ঘরবাড়ী অনেক ছোট লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় ৩০০০০ ফুট উপরে চলে গেলাম। এবারেও সিট জানালার পাশে। অসম্ভব আনন্দ নিয়ে বাইরে তাকিয়ে মেঘ দেখতে থাকলাম.........

ঢাকায় পৌঁছাব আর মাত্র ২ ঘণ্টা পর। এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে। জাপান ভ্রমণ শেষের দিকে। এতটা ভাল লাগবে জাপানে ভাবতে পারিনি। প্রতিটা মুহূর্ত সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যা যা দেখতে চেয়েছিলাম সব দেখেছি। কোন অতৃপ্তি ছিলনা। প্লেনেও খরচ অনেক কম হয়েছে। এ ব্যপারে তথ্য দেবার জন্য হাদি,রুবেল,সুরভি,নেহাল ভাই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য । তবে গ্রুপ ট্যুর হলে চায়না ইস্টার্ন এয়ার ভাল হবে। আর ফ্যমিলি নিয়ে গেলে যেগুলো একবার থামে সেগুলোতে যাওয়া উচিত। কুনমিং থেকে যখন ঢাকার পথে তখন একবার বিমান কাঁপতে শুরু করল। বেশ জোরেশোরে । সবাই ভয় পেয়ে গেল। আমিও। কারো একজন মন্তব্য শুনলাম লোকাল বাসে একটু ঝাঁকি হবেই। বাকী সময় নির্বিঘ্নে কাটল । খাবারও ভাল লাগল । আসলে মনে আনন্দ থাকলে সব ভাল লাগে। তারপর একসময় প্লেন যখন বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করল অসীম শান্তি অনুভব করলাম।আর মাত্র ৩০-৪০ মিনিট । 

এই সময়টাও যেন আর কাটতে চায়না। প্লেন সর্বসাকুল্যে ২৫ মিনিট লেট হল। যখন ঘোষণা এল অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছি , সিট বেল্ট বেঁধে নিন। সীট বেল্ট বাঁধতে ইচ্ছে করছিল না। ভাবলাম এখনি তো নেমে যাব বেঁধে লাভ কি ? রুপম রাজশাহী থেকে ঢাকায় গেছে আমাকে আনার জন্য। এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষা করবে। ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি চীন থেকে। বিমানের চাকা যখন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করল এক অনবদ্য আনন্দ মনের ভেতরে অনুভব করলাম। অদ্ভুত টাইপের অনুভূতি । যে আনন্দ পৃথিবীর আর কোথাও নেমে পাওয়া যাবেনা । বিমান থেকে নামলাম । ফোনে সবার সাথে যোগাযোগ হল। রুপম এসেছে। বাইরে আছে। ছয় ঘণ্টা জার্নি করে রাজশাহী থেকে এসেছে। ইমিগ্রেশনে ১ মিনিটের মত সময় লাগল । 

লাগেজ পেতে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। এই জিনিসটাই খুব বিরক্তিকর। চীনে বা জাপানে লাগেজ পেতে অপেক্ষাই করতে হয়নি। একবার নাহারিন আর আনিশাকে নিয়ে বিমানে রাজশাহী থেকে ঢাকায় গিয়েছিলাম। সময় লেগেছিল ৩৫ মিনিট আর লাগেজ পেতে ৪৫ মিনিট । এই ব্যপার টা অবশ্যই খেয়াল করা দরকার। আমি না সবাই বিরক্ত হয়। সবাই পারলে আমরা পারব না কেন? বের হয়ে সিএনজি নিয়ে এলিফ্যনট রোডে চলে গেলাম। ব্লেজার কেনা হল। জাপানে যেসব দেখেছিলাম সেগুলো আমার ভাল লাগেনি। তারপর সরাসরি কল্যাণপুর বাস ষ্টেশনে আসলাম। নান রুটি আর গ্রিল খেলাম । ন্যশনালের ৬ টার বাসে উঠলাম আর রাত ১২ টায় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শহর রাজশাহীতে পৌঁছালাম। রুপমকে বিদায় দিয়ে বাসায় এসে দেখি আনিশা ঘুমিয়ে গেছে। নাহারিন অনেক কিছু রান্না করেছিল তৃপ্তি করে খেলাম। সব কিছুর জন্য আমি কৃতজ্ঞ আমার সৃষ্টিকর্তার প্রতি। তাঁর নির্দেশ ছাড়া তো কিছুই হয়না। এরপর কৃতজ্ঞতা পাপলুর প্রতি ,শুভর প্রতি। তারা আমার জন্য যত কিছু করেছে কোন তুলনাই হয়না। কোনদিনই এটা ভুলে যাবার নয়! ধন্যবাদ জানাই নাহারিন কে। অবশ্য প্রতিদিনই যোগাযোগ হয়েছে । সুতরাং দূরত্ব যতই হোক কাছে থাকা হয়েছে ! আনিশা ফোন করে বলত , আব্বু খেলনা নিয়ে আসবা।চকলেট নিয়ে আসবা। তাকে নিরাশ করিনি। ধন্যবাদ আব্বু আম্মুকে বিভিন্ন উপদেশ ও ইয়েন দিয়ে সাহায্য করার জন্য। 

ধন্যবাদ রুবেল ও সুরভীকে চৈনিক মুদ্রা এবং বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার জন্য। ধন্যবাদ জানাই প্রিয় প্রফেসর আজিজ স্যারকে। ছুটি নিতে গেলে স্যার বলেছিলেন, কয়েকদিন আগেই তো মালয়শিয়া গেলে আবার জাপান কেন? পাশ করে তারপর ঘুরে বেড়াও । বলেই স্যার হাসতে হাসতে সই করে দিলেন। আমি স্যারের অনুগত ছাত্র। স্যারের কথা না রেখে কি পারা যায় ? ধন্যবাদ জানাই ডাঃ মাহাবুবুর রহমান খান বাদশাহ স্যারকে। স্যারের ও জাপান খুব ভাল লেগেছিল। কারণ জিজ্ঞাসা করলে স্যার বলেছিলেন জাপানে কোন বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলা স্যারের চোখে পড়েনি । পরে আমারও স্যারের মতই অনুভূতি হয়েছিল। ধন্যবাদ জানাই প্রবীর স্যার, বলাই স্যার , সমীর স্যার কে। রাশেদ , পলাশ , আবদুল্লাহ অবশ্যই ধন্যবাদ পাবে।বিশেষ করে রাশেদ। ওয়ার্ডে একজন না থাকলে আরেকজনের আসলেই অনেক কষ্ট হয়। ধন্যবাদ আমার ওয়ার্ডের সকল ইন্টার্ন চিকিৎসকদের । আরও ধন্যবাদ অরূপ ভাই, কাজল ভাই, নিপু আপু,শিমন ভাই, গোলাপ ভাই, মামুন ভাই, সাগর ভাই, জামি,বিথি,ইলোরা আপু মামুন, বাশার , জাফর,ফরিদ,রুহুল ভাই কে সবসময় উৎসাহ প্রদান করার জন্য। জাহিদ, সাক্লায়েন ভাই, রাজীব ভাইকে ধন্যবাদ। আমি কৃতজ্ঞ সবার প্রতি যারা আমাকে ভালবাসেন । সবসময় উৎসাহ দেন। আসলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের ভালবাসাই শুধু দরকার। আর মনে হয় কিছু না। আমি পেয়েছি এবং উজাড় করেই পেয়েছি। এজন্যই সাহস করে জাপান ভ্রমণের স্মৃতি লিখে ফেললাম।


 

Leave a Comment