বিশ্বের প্রথম ইনসুলিনের গল্প

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
  • আগস্ট ৯, ২০১৮

ব্যান্টিং  একজন ঋণের দায়ে পৃষ্ঠ হতাশাগ্রস্ত সার্জন। শর্করা পরিপাকের উপর একটা লেকচার দিতে হবে ছাত্রদের, সেটার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন সময় তাঁর হাতে এল ব্যারনের আবিষ্কারের খবর। তিনি সন্দেহ করলেন প্যানক্রিয়াসের হজমকারী তরলের প্রভাবে আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহেন্স এর তরল হজম হয়ে যায়। আর আমরা আগেই বলেছি, হজমকারী তরল আসে নালী দিয়ে। ব্যারন দেখতে পেয়েছেন এই নালীতে পাথর জমলেও আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহেন্স ঠিক থাকে। ব্যান্টিং সিদ্ধান্তে আসলেন, যদি এই নালী বন্ধ করে দেয়া হয়, এর প্রভাবে প্যানক্রিয়াসের বিভিন্ন কোষের ধ্বংস পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়, তারপরে যেটা অবশিষ্ট থাকবে সেটার তরলই হবে ইনসুলিন। ব্যান্টিং খুব কম জানতেন । তাই তিনি জানতেন না এই কাজ করতে যেয়ে কত বিজ্ঞানী ব্যর্থ হয়েছেন । এটাই তাঁর শক্তি ছিল । তিনি তাঁর ধারণায় অটল থাকেন । তিনি চলে যান বিজ্ঞানী জে জে আর ম্যাক্লিওডের কাছে ( ক্লিনিকাল একজামিনেশনের ম্যাকলিয়ড না কিন্তু)। ম্যাক্লিওড জানতেন এই কাজ করতে যেয়ে কতজন ব্যর্থ হয়েছে, তবুও তিনি রাজি হলেন দুইটি কারণে।

প্রথমতঃ ব্যান্টিং বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধ ক্যাম্পে সার্জারি করেছেন, তাই সেই সময় তিনি যে পরিমাণ সার্জারি শিখেছেন, কোন ডাক্তার শান্তিকালীন সময়ে সারাজীবনেও তা পারবেন না। অতএব প্যাঙ্ক্রিয়াসের নালী কাঁটা, সেই প্যানক্রিয়াস পরে অন্য কোন ডায়াবেটিক কুকুরের বসিয়ে পরীক্ষা করা যে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিনা, এই অপারেশন গুলো ব্যান্টিং এর মত দক্ষতা নিয়ে খুব কম মানুষ করতে পারবে ।দ্বিতীয়তঃ এর আগে অনেক বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে চেষ্টা করলেও প্যানক্রিয়াসের সব হজমকারী কোষের চূড়ান্ত ধ্বংসের পর কি হয়, এতদূর কেউ পর্যবেক্ষণ করেন নি। তাই তিনি রাজি হলেন। তবে ব্যান্টিং কে গবেষণা শুরুর আগে নিজের সার্জারি প্র্যাকটিসে স্থায়ী হয়ে নিতে বললেন, যাতে গবেষণার ফলাফল শুন্য হলেও ব্যান্টিং কোন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে না পরেন ।

এই সময়ে ম্যাক্লিওডের কাছে দুইজন ছাত্র ছিলেন বেস্ট এবং নোবেল। তিনি তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি থেকে সময় বের করে ব্যান্টিং-কে সাহায্য করতে বললেন। তিনি বলেন, যদি গবেষণার ফলাফল শুন্য ও হয়, ব্যান্টিং এর মত সার্জনের কাছ থেকে সার্জারির ব্যাপারে অনেক কিছু শেখার আছে। বেস্ট এবং নোবেলের মধ্যে মুদ্রা নিক্ষেপ হয়, বেস্ট জিতে যান। তাই তিনিই ব্যান্টিং কে সাহায্য করবেন বলে ঠিক হয়। ওদিকে ব্যান্টিং ও মুদ্রা নিক্ষেপ করলেন হেড আর টেলের জন্য। কারণ সার্জারি প্র্যাকটিসে এখন তিনি খ্যাতির চূড়ায়। কানাডার এক অঞ্চলে তেলের খনিতে দল পাঠানো হবে, সেখানে মেডিকেল অফিসার লাগবে। ব্যান্টিং সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলেন। মুদ্রায় হেড উঠলে গবেষণায় যাবেন, টেল উঠলে তেলের খনি । ৫ বারে ৩ বার টেল উঠল । কিন্তু তেলের খনির দল জানিয়ে দিল, কোন মেডিকেল অফিসার যাচ্ছেন না। তাই তিনি বেস্টের সাথে গবেষণায় যুক্ত হলেন। ম্যাক্লিয়ড টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি বিভাগের ১০ বছরের পুরনো রুম খুলে দিলেন। সেই রুম ব্যান্টিং এবং বেস্ট পানি ঢেলে পরিষ্কার করতে যেয়ে নীচের তলা থেকে অভিযোগ পেলেন পানি লিক করছে। শেষমেশ তাঁরা হাঁটু গেড়ে হাত দিয়ে রুম পরিষ্কার করলেন। সেই রুমেই জন্ম নেয় ইনসুলিন।

তাঁরা প্রথমে একটি কুকুরের প্যানক্রিয়াস লাইগেট করে ম্যাক্লিওডের পরামর্শে সেটি ঠাণ্ডায় সংরক্ষণ করেন। এরপর প্যানক্রিয়াসের নালী সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হলে সেটি একটি ডায়াবেটিক কুকুরে প্রতিস্থাপন করলেন। কুকুরটি সুস্থ হল। ম্যাকলিওড এবার যোগ দিলেন। তিনি পুরো প্রক্রিয়া আবার করতে বললেন। ফলাফল একই আসল। এবার চূড়ান্ত ধাপ। প্যানক্রিয়াস থেকে এই ইনসুলিন আলাদা করে মানুষে ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। বেশ কয়েকজন এই ধাপে ব্যর্থ হয়েছেন এর আগে। এই সময় রকফেলার ইন্সটিটিউট ভ্রমণ বৃত্তি পেয়ে কানাডায় এসেছেন বায়োকেমিস্ট কলিপ। তিনি বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে তরল বের করে প্রাণীদের সেই তরল ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দিয়ে সুস্থ করেছেন। ম্যাক্লিওড তাঁকে একই কাজটা কুকুরের নালী বিহীন প্যানক্রিয়াস থেকে তরল ইনসুলিন বের করে মানুষে প্রয়োগ করতে বলেন। অবশেষে- ব্যান্টিং, বেস্ট, ম্যাকলিওড এবং কলিপ প্রস্তুত।

১৪ বছর বয়সী ডায়াবেটিসের রোগী থম্পসনের দেহে প্রথম ইনসুলিন দেয়া হল। কিন্তু তার কোন উন্নতি হল না, বরং বিষক্রিয়া হল। সবাই হতাশ হলেন। কিন্তু গ্রন্থি থেকে প্রাপ্ত তরল জীবনের উপযোগী করতে ওস্তাদ কলিপ হার মানলেন না। টানা বারো দিন জেদ ধরে গবেষণা চালিয়ে ইনসুলিনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশুদ্ধ করে ছাড়লেন। আবার থম্পসনকে ইনসুলিন দেয়া হল। ব্লাড সুগার বিস্ময়কর ভাবে কমে গেল। পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে থম্পসন ডায়াবেটিস নিয়েই স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেন। সারা বিশ্বে এই খবর ছড়াল। আমেরিকানরা জেনেটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের ইনসুলিন কপি করলেন। আমরা যেভাবে কাগজ ফটোকপি করি সেভাবে জেনেটিক প্রযুক্তি মানুষ থেকে সামান্য ইনসুলিন নিয়ে অসংখ্য কপি বানিয়ে চলেছে। ম্যাক্লিয়ড এবং ব্যান্টিং নোবেল পুরস্কার পান। ব্যান্টিং, বেস্টের নাম না থাকায় রেগে যান। তিনি তাঁর পুরস্কার বেস্টের সাথে ভাগ করে নেন। ম্যাকলিওড তাঁর পুরস্কার কলিপের সাথে ভাগ করেন।

আর/এস 

Leave a Comment