জেনে নিন পুরুষের স্তন ক্যানসারের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে 

  • ওমেন্সকর্নার ডেস্ক 
  • ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৮

স্তন ক্যানসার সচেতনতার প্রতীক যদিও ‘গোলাপী রিবন’ কিন্তু তাই বলে আপনি নিশ্চিন্তে থাকবেন না। পুরুষদেরও স্তন ক্যানসার হতে পারে। মাউন্ট সিনাই বেথ ইসরায়েলের ব্রেস্ট সার্জারির প্রধান সুসান কে. বুলবল বলেন, ‘সাধারণ প্রশ্ন হচ্ছে: পুরুষের যদি স্তন না থাকে, তাহলে তাদের কিভাবে স্তন ক্যানসার হতে পারে? আমি বলবো, অবশ্যই তাদের স্তন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’ পুরুষেরা অল্প পরিমাণ স্তন টিস্যু নিয়ে জন্ম নেয় এবং তাদের স্তনের বৃদ্ধি নারীদের মতো না হলেও সেখানে স্তন ক্যানসার বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির মতে, ‘বর্তমানে, স্তন ক্যানসার নারীদের তুলনায় পুরুষদের খুব কম- প্রায় ১০০ গুণ কম।’ পুরুষের মধ্যে স্তন ক্যানসার বিকাশের সম্ভাবনা সামান্য হলেও তা প্রাণনাশক হতে পারে। চলুন জেনে নেওয়া যাক, পুরুষের স্তন ক্যানসার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য।

স্তনে পিণ্ড হওয়া : ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এমডি অ্যান্ডারসন ক্যানসার সেন্টারের ব্রেস্ট মেডিক্যাল অনকোলজির প্রফেসর এবং ব্রেস্ট ক্যানসার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ইনভেস্টিগেটর শ্যারন হার্মিস জিওর্দানো বলেন, ‘আপনার বুকের স্তনে পিণ্ড অনুভূত হওয়া কিংবা পিণ্ড বা ডেলা বা দলা হওয়া- হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের স্তন ক্যানসারের প্রথম উপসর্গ।’ প্রায়ক্ষেত্রে, পিণ্ড বা ডেলা সরাসরি নিপলের পেছনে পাওয়া যায়, কিন্তু তা স্তনের যেকোনো জায়গায় পাওয়া যেতে পারে। ডা. বুলবল বলেন, আপনি বগলে বর্ধিত লসিকাগ্রন্থিও অনুভব করতে পারেন। ডা. বুলবলের মতে, অন্য একটি উপসর্গ হচ্ছে নিপলে পরিবর্তন হওয়া, যদিও এ পরিবর্তন আপনি যে পিণ্ড বা দলা অনুভব করছেন তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তিনি বলেন, নিপলের আকৃতি পরিবর্তন হতে পারে অথবা নিপল ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। ডা. জিওর্দানো বলেন, আমার কিছু রোগী আছে- যাদের স্তন থেকে রক্তপাত হয়েছে এবং তা হতে পারে আরেকটি উদ্বেগজনক উপসর্গ।

স্তন ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস আপনাকে ঝুঁকির মধ্যে রাখে: স্তন ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে অর্থাৎ আপনার পরিবারে কোনো নারী বা পুরুষের অতীতে স্তন ক্যানসার হয়ে থাকলে, তা আপনাকে ঝুঁকিতে রাখতে পারে। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির মতে, পুরুষ স্তন ক্যানসার রোগীদের প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় রয়েছে, যারও স্তন ক্যানসার ছিল। অনেক ক্ষেত্রে, উত্তরাধিকারসূত্রে বিআরসিএ১ বা বিআরসিএ২ জিন মিউমিটেশন পাওয়ার কারণে স্তন ক্যানসার হয়ে থাকে। আপনি সম্ভবত শুনে থাকবেন যে, অস্কার বিজয়ী হলিউড অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলির স্তন ক্যানসার উত্তরাধিকার জিনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। কিন্তু এটি পুরুষকেও ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

পুরুষের সকল স্তন ক্যানসার বিআরসিএ জিন মিউটেশনের দ্বারা সৃষ্টি না হওয়া সত্ত্বেও এটি আপনাকে উল্লেখযোগ্য উচ্চ ঝুঁকিতে রাখতে পারে। আপনার যদি বিআরসিএ২ জিন মিউটেশন থাকে, তাহলে আপনার জীবনকালে ক্যানসার বিকাশের ঝুঁকি ১০০ এর মধ্যে ৬-এ চলে আসতে পারে। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির মতে, যদি আপনার বিআরসিএ১ মিউটেশন থাকে, তাহলে ঝুঁকি ১০০-তে ১। বিআরসিএ মিউটেশন প্রস্টেট ক্যানসার বা মূত্রথলি ক্যানসার এবং প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার বা অগ্ন্যাশয় ক্যানসারসহ অন্যান্য ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।

ডা. জিওর্দানো বলেন, আপনার কোনো রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়ের মধ্যে যদি বিআরসিএ জিন মিউটেশন থাকে (এটি পিতামাতার মাধ্যমে সন্তানের মধ্যে প্রেরিত হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ) অথবা যদি আপনার স্তন ক্যানসারের জোরালো পারিবারিক ইতিহাস থাকে- তাহলে আপনার ঝুঁকি বোধগম্য হওয়ার জন্য জেনেটিক টেস্ট হতে পারে স্মার্ট পদক্ষেপ, যার ফলে আপনি যেকোনো সম্ভাব্য ক্যানসার নির্দেশক স্তন পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।

শারীরিক কিছু অবস্থা পুরুষের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে : ডা. বুলবল বলেন, ‘যদিও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধির জন্য পারিবারিক ইতিহাস বড় উদ্বেগের বিষয়, শারীরিক কিছু অবস্থাও আপনার ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে- উদাহরণস্বরূপ, ইস্ট্রোজেন বৃদ্ধির কথা বলা যায়।’ ডা. জিওর্দানো বলেন, ‘পুরুষ স্তন ক্যানসার রোগীদের মধ্যে হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (বিশেষ করে ইস্ট্রোজেন) টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে।’ এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের মধ্যে হওয়া অন্যান্য স্তন ক্যানসারের বিপরীত (যেমন- ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার)।

আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির মতে, যদিও পুরুষের স্তন ক্যানসারের অধিকাংশ কারণ অজ্ঞাত, ধারণা করা হয় যে, হরমোনের মাত্রা এই ক্যানসার বিকাশে ভূমিকা রাখে- কারণ, ইস্ট্রোজেনের মতো নারী হরমোনের প্রতিক্রিয়ায় স্তন কোষ বৃদ্ধি পায় ও বিভাজিত হয়। যত বেশি বিভাজিত হওয়ার ঘটনা ঘটবে, ডিএনএ কপি প্রক্রিয়ায় তত বেশি গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর ফলে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি এবং বিস্তার বেড়ে যেতে পারে। ইস্ট্রোজেন সম্পর্কিত একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যকৃত রোগ (যেমন- সিরোসিস বা সিভিয়ার লিভার স্কারিং বা যকৃত ক্ষত, যা অনেকদিন ধরে মদ্যপান করলে হয়)। আমেরিকান সোসাইটির মতে, তীব্রমাত্রার যকৃত রোগে ভোগা পুরুষদের প্রায়ক্ষেত্রে টেসটস্টেরনের মতো অ্যান্ড্রোজেন বা পুরুষ হরমোন কম থাকে এবং উচ্চমাত্রায় ইস্ট্রোজেন থাকে। স্থূলতাও পুরুষ ও নারী উভয়কেই উচ্চ ঝুঁকিতে রাখে, কারণ চর্বি কোষ অ্যান্ড্রোজেনকে ইস্ট্রোজেনে রূপান্তর করে। এছাড়া স্থূলতা অন্যান্য অনেক ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। প্রায়ক্ষেত্রে লিমফোমার মতো ক্যানসারের চিকিৎসা করতে যেসব পুরুষের বুকে রেডিয়েশন চিকিৎসা সম্পাদিত হয়েছে, তারাও উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে।

পুরুষের স্তনের জন্য স্তন পিণ্ড নির্ণয়ে বিভ্রান্তি হতে পারে : পুরুষের স্তন পিণ্ড নির্ণয়ে বিভ্রান্তি (সাধারণ দৃষ্টির আলোকে) সৃষ্টিমূলক অবস্থা উচ্চমাত্রার ইস্ট্রোজেনের সঙ্গে সম্পর্কিত। উচ্চমাত্রার ইস্ট্রোজেনের কারণে গাইনিকোম্যাস্টিয়া সৃষ্টি হয়, যা সাধারণত পুরুষের স্তনের টিস্যু বৃদ্ধির কারণে হয়ে থাকে আর এ অবস্থাকে আপনি পুরুষের স্তন ভাবতে পারেন। এটি প্রায়সময় স্তন পিণ্ড নির্ণয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে (সাধারণ দৃষ্টি বিবেচনায়)। ডা. বুলবল বলেন, ‘পুরুষরা ব্রেস্ট সার্জনের কাছে যাওয়ার সবচেয়ে কমন কারণসমূহের একটি হচ্ছে, পুরুষের স্তনে পিণ্ড তৈরি হয়েছে। এটি প্রায়ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারের পরিবর্তে গাইনিকোম্যাস্টিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’ ডা. বুলবলের মতে, ‘গাইনিকোম্যাস্টিয়া নিজে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় না, কিন্তু যেহেতু এটির সঙ্গে উচ্চমাত্রার ইস্ট্রোজেন সম্পর্কিত আছে- সেহেতু নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে এটি শুধুমাত্র গাইনিকোম্যাস্টিয়া।’ যদি এটি স্তন পিণ্ড না হয়ে থাকে, একজন ফিজিশিয়ান নির্ধারণ করতে পারেন এটি কেন হচ্ছে।

পুরুষের স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা রয়েছে : প্রত্যেক রোগীর অবস্থা ভিন্ন হলেও পুরুষ ও নারীর স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় বেশ মিল রয়েছে। ডা. বুলবল বলেন, ‘যখন একজন পুরুষ স্তন পিণ্ড বা ডেলা নিয়ে আমাদের কাছে আসে, আমরা প্রায়ক্ষেত্রে নারীদের জন্য যা করি তার জন্যও তা করি- যেমন, ম্যামোগ্রাম ও আল্ট্রাসাউন্ড নিয়ে থাকি।’ এটি আপনার ডাক্তারকে বোধগম্য করবে যে আপনার ক্যানসার কোষ পরীক্ষার জন্য বায়োপসি লাগবে কিনা। যদি স্তন ক্যানসার ডায়াগনোসিস বা নির্ণীত হয়, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ সাধারণত সার্জারি। ডা. জিওর্দানো বলেন, ‘অধিকাংশ পুরুষকে মাস্টেক্টমি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, এমনকি তাদের খুব ক্ষুদ্র স্তন টিস্যু থাকলেও।’ তিনি বলেন, ‘এরপর সার্জন বগলের লসিকাগ্রন্থির বায়োপসি করবেন যাতে তিনি নিশ্চিত হতে পারেন যে ক্যানসার বিস্তার লাভ করেনি।’ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন প্রদান করা হয়।

ডায়াগনোসিস বিলম্ব হলে পুরুষের স্তন ক্যানসার প্রাণঘাতী হতে পারে : একই পর্যায়ে পুরুষ ও নারীর স্তন ক্যানসার ডায়াগনোসিস বা নির্ণীত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের আরোগ্যলাভের হার একই। এ প্রসঙ্গে ডা. বুলবল বলেন, ‘তারা উভয়েই যদি প্রথম পর্যায়ে অবস্থান করে, তবে তাদের সামগ্রিক আরোগ্যলাভ সম্ভাবনা একই। দ্বিতীয় পর্যায়েও একই (এবং অন্যান্য পর্যায়েও তাই)।’ অনেক পুরুষ স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা করে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, এটি তাড়াতাড়ি শণাক্ত করতে পারলে এটিকে দমন করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ডা. জিওর্দানো বলেন, ‘স্তন পিণ্ড অনুভব করার পরও অনেক পুরুষ ভাবে না যে এটি ক্যানসার হতে পারে, তাই তারা ডাক্তারের কাছে যায় না।’ তিনি আরো বলেন, ‘তারা বড় বড় টিউমার নিয়ে হাজির হওয়ার প্রবণতাযুক্ত এবং এসব টিউমারের সঙ্গে লসিকাগ্রন্থির সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।’

তথ্য এবং ছবি : গুগল 

Leave a Comment