শেষ চিঠি

  • চিত্রলেখা সরকার 
  • ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮

কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শীতবুড়ি প্রচন্ড শিহরণ তুলেছে সমগ্র প্রকৃতি ও জনজীবনে। ঘণ্টা চারেক আগেই সূর্য উঁকি দিয়েছে পূর্ব আকাশে। কিন্তু সকালের রোদটা অভিমানী মেয়ের মতো ম্লান হয়ে আছে। ছুটির দিন তাই কাজল (পার্থের স্ত্রী) ওর দিদির বাসায় বেড়াতে গেছে। বাসায় শুধু মা আর পার্থ। পূবের বেলকুনিতে একটা ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে একটা চিঠি হাতে নিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে পড়ছিল পার্থ...

প্রিয়তুমি,

আমি ভালো আছি। জানি তুমিও। আর কেউ তোমায় ভাল বাসুক বা না বাসুক আমি কিন্তু তোমায় আজও ভালবাসি ঠিক আগের মতোই। তোমার ওপর কোন রাগ, অভিমান, ঘৃনা, অভিযোগ কোন কিছুই নেই আমার। আছে কেবল সহজ সরল চাওয়া-পাওয়া হীন ভালবাসা। যাকে একবার ভালবাসা যায় তাকে কি কখনো ঘৃণা করা যায়? যায় না। ভালো মন্দ মিলিয়ে ই একটা মানুষ। তাই তোমার ভাল মন্দ দুটোকেই আমি ভালবাসি ভীষণ। এ পর্যন্ত পড়েই থেমে গেল পার্থ....

আজ প্রায় দীর্ঘ আট বছর পর নম্রতা'র চিঠি। পার্থ যখন অনার্স প্রথম বর্ষে তখন নম্রতার সাথে ওর পরিচয় হয়। নম্রতা ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো। কলেজের একটা ফাংশনে গান গেয়েছিল নম্রতা। ভারি মিষ্টি গানের গলা নম্রতার। সেই প্রথম দেখাতেই নম্রতাকে ভালো লেগেছিল পার্থের। নম্রতা লম্বায় প্রায় পাঁচফুট দু'ইঞ্চি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলা যায়। গায়ের রং একটু কালো। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল প্রায় হাটু পর্যন্ত। বেশ বড়বড় দুটো চোখ। থুতনি তে একটা কালো তিল আর ডান গালে একটা টোল। হাসলে ভারি সুন্দর দেখায়। সারা মুখখানিতে একটা অসম্ভব মায়া আছে। নম্রতার বাবা একজন স্কুল টিচার। নম্রতার আরো দুটো বোন আছে। নম্রতার মা মারা গেছে যখন তার বয়স পনের। বাবা আর বিয়ে করেনি। কাজেই সংসারের সকল দ্বায়িত্ব ছিল নম্রতার ওপর। নম্রতা খুব বুদ্ধিমতি আর ভীষণ দৃঢ় চিত্রের।

পার্থ উচ্চতায় প্রায় পাঁচফুট ছয়। গায়ের রং কাঁচা হলুদের মতো। মাথা ভর্তি ঝাকড়ানো চুল প্রায় কাঁধ পর্যন্ত। ঠিকালো নাক, টুকটুকে লাল দুটো ঠোট। এক কথায় রাজপুত্র। আর ভীষণ জেদি আর চঞ্চল। পার্থের বাবা উকিল। অনেক টাকা পয়সার মালিক। পার্থ বাবা মার একমাত্র সন্তান।
নম্রতাকে কনভেন্স করতে টানা দু'বছর লেগেছিল পার্থের। চিঠি লিখতে খুব ভালোবাসতো নম্রতা।তাই পার্থ সপ্তাহে একটি চিঠি লিখতো নম্রতাকে। চিঠির সাথে একটা করে পুতুল। প্রথম প্রথম নম্রতা একদম ই পাত্তা দেয়নি। হয়তো কোন চিঠি খুলেও দেখতো না। যেভাবে এসেছে সেভাবেই রেখে দিতো। প্রায় দু'বছরের মাথায় একদিন কলেজের লাইব্রেরীতে একা একা বসে ছিল নম্রতা হঠাৎ ই সেখানে পার্থ গিয়ে উপস্থিত হলো। এবং বললো...

- তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমি তোমাকে ভালবাসি। নিজের থেকে বেশি কিনা বলতে পারবো না তবে অনেক ভালবাসি। প্রমান চাইলে তাও দিতে পারি। প্রায় আশি টা চিঠি দিয়েছি তোমায়। আমার একটা চিঠির ও উত্তর দাও নি। আমি আর পারছি না।

- তুমি আমায় ভালবাসো?

- হ্যাঁ।

- কেন?

কি বলবে নম্রতাকে ভেবে পাচ্ছিলো না পার্থ। তাই মাথা টা নিচু করে শুধু বলেছিল...

- জানিনা।

উত্তরটা শুনে শব্দ করে হেসে উঠেছিল নম্রতা। সেই থেকে শুরু.....

কথায় আছে, "অতি আকাঙ্খিত বস্তু হাতের মুঠোয় এলে তার মূল্য কমে যায়। এক্ষেত্রে ও তেমনটাই হয়েছিল। ভাবনার জগত থেকে পার্থ আবার চিঠিতে মনোনিবেশ করলো। নম্রতা লিখেছে...

প্রিয়তুমি,

তোমায় ভোলার চেষ্টা করিনি। কেননা সেটা অসম্ভব। শরীরটাকে হয়তো চার দেয়ালের মাঝে আটকে রাখা যায়। কিন্তু মন? তাকে আটকে রাখার সাধ্য আমার নেই। ভেবে দেখলাম এক জীবনে আর কত জনকে ভালবাসা যায়? বিয়েটা তাই করা হয়ে ওঠেনি। সুখের আশায় মুক্তি নিয়ে এসেছো। সত্যিই কি সুখী হতে পেরেছো?পার্থ লেখাগুলো স্পষ্ট দেখতে পারছিল না। কারন চোখ দুটো তার জলে ভরে গেছে। প্রতিটা মুহুর্ত আজ নম্রতা কে মিস করে সে। সংসার তার সুখ নেই এতটুকু। ভারি বদমেজাজি আর উগ্র স্বভাব কাজলের। অনেক বড় লোকের মেয়ে সে। আর ভীষণ দাম্ভিক। পার্থ যে হীরে ফেলে কাঁচ কুড়িয়ে এনেছে সেটা আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধ করতে পারছে। সাত বছর বিয়ে করেছে পার্থ কিন্তু কোন সন্তান নেই তাদের। ডাক্তার বলেছে সমস্যা কাজলের।

নম্রতার যে গুনগুলো একদিন তাকে মুগ্ধ করেছিল। কেন জানিনা আস্তে আস্তে সেগুলোই খারাপ লাগতে লাগলো তার কাছে। নম্রতা বুঝতে পেরেছিল।বলেছিল...

- "আমি তোমায় জোর করে ধরে রাখবো না। ভালবাসা যেটুকু পাওয়ার আমি পেয়েছি। শারীরিক ভোগ বিলাসে কোন লোভ নেই আমার। তোমায় মুক্তি দিলাম যাও।"

ভীষণ দৃঢ়তা ছিল ওর গলায় সেদিন। পার্থের যে কাজলের সাথে ঘনিষ্টতা হয়েছিল সেটা নম্রতা জানতে পেরেছিল। কাজল ছিল অসম্ভব সুন্দরী। পার্থের ইয়ারমেট। একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি নম্রতা। সেই ছিল ওর সাথে শেষ দেখা। এত বছরে ওর সাথে আর কোন যোগাযোগ করতে পারেনি পার্থ। একবার ক্ষমা চাওয়া সুযোগ ও দেয়নি নম্রতা। এই আট বছরের প্রতিটা মুহুর্ত অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছে পার্থ। আজ দীর্ঘ আট বছর বাদে সেই নম্রতার চিঠি। কিন্তু চিঠিতে নম্রতার ঠিকানা লেখা নেই। চিঠি টা এসেছে কুরিয়ারে। নম্রতা লিখেছে...

প্রিয়তুমি,
তোমার চিঠির বান্ডিল আর পুতুলগুলো যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছি আলমারিতে। ওগুলো ই তো আমার বেঁচে থাকার এক মাত্র আশা। তোমার স্মৃতিগুলো আমায় প্রতিদিন নতুন করে বাঁচতে শেখায়। কাজল কেমন আছে? অনেক অনেক ভালবাসবে ওকে।সংসারে ভালবাসা না থাকলে সুখ আসে না। খুব দেখতে ইচ্ছে করে তোমায়। কিন্তু এ জীবনে আর সে আশা পূর্ণ হবে না জানি। আমার কথা মনে করে কষ্ট পেওনা। আমি সত্যিই অনেক ভালো আছি। তুমি ভালো থেকো।
ইতি
'নম্রতা'

নির্বাক হয়ে গেছে পার্থ। দুচোখ দিয়ে কেবল অবিরাম জল পড়ছে তার........

Leave a Comment