‍‍`আমার আম্মু বলে আমার কলিজা আমার থেকেও বড়! ‍‍`

  • ফারজানা আক্তার
  • আগস্ট ১২, ২০২১

তাসলিমা বাবলী! দারুণ উদ্যমী এবং প্রাণচঞ্চল একটি মেয়ে। আমাদের সমাজে যেখানে অবিবাহিত মেয়েরা ঘুরতে যেতে চাইলে পরিবার থেকে বলা হয় ' বিয়ের পর স্বামীর সাথে যাইস। ',  সেখানে বাবলী অনলাইন ভিত্তিক ট্রাভেল গ্রুপের উদ্যোক্তা। বাবলীর ট্রাভেল গ্রুপের নাম প্রকৃতিযাত্রী। নিজে লিড দিয়ে টিম নিয়ে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিঃসন্দেহে বাবলী সাহসী। আজকে আমরা তার সাহসিকতার গল্প জানবো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারজানা আক্তার। 

ওমেন্সকর্নার : লকডাউনে টুরিস্ট স্পট সব বন্ধ। কিভাবে কাটাচ্ছেন সময় ?

তাসলিমা বাবলী : বিস্তারিত ভাবে বলতে গেলে অনেক লম্বা উত্তর হয়ে যাবে! অনেক কাজই করছি। সিনেমা-সিরিজ দেখা, বই পড়া, রান্নাবান্না করছি মন ভালো রাখার জন্য। আর প্রকৃতিযাত্রীতে বেশি সময় দিচ্ছি। গ্রুপের গ্রোথ বাড়ানোর ব্যাপারে কাজকর্ম করছি। সামনে কি, কি ট্যুর দিবো সেই ব্যাপারে প্ল্যান সাজাচ্ছি।

ওমেন্সকর্নার : আমাদের সমাজে মেয়েদের ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক নিয়ম কানুন আছে। সেখানে আপনি পুরো একটি ট্রাভেল গ্রুপ চালাচ্ছেন। শুরুটা কতটা কঠিন ছিলো ?

তাসলিমা বাবলী :  যথেষ্ট পরিমাণ কঠিন ছিলো। আমার দিক থেকে আমি হাজারটা মানুষ বা সমাজকে কখনোই বোঝাতে চাইনি। বোঝাতে চেয়েছি আমার পরিবারকে। আমার পরিবার আমাকে অনেক ধরনের স্বাধীনতা দিলেও একা ঘুরতে চলে যাওয়ার স্বাধীনতটা খুব সহজে দেয়নি। অনেকটাই লম্বা গল্প। আম্মুকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, সেটা পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ্। আমি বা একটা একটা মেয়ে ঘুরতে গিয়ে নিজের দায়িত্ব নিতে পারে এটা বোঝানোই ছিলো আসল চ্যালেঞ্জ।

ওমেন্সকর্নার :  পরিবার থেকে কেমন সাপোর্ট পেয়েছেন ?

তাসলিমা বাবলী :  শুরুতে একদমই পাইনি। আর গোটা দশটা বাঙালী পরিবারের মতোই বাঁধা এসেছিলো। কিন্তু আমার পরিবার যখন বুঝতে পেরেছে আমার ভরসায় আরো দশটা মেয়ে ঘুরতে পারছে, তখন থেকে বরাবরই সাপোর্ট পাচ্ছি।

আরো পড়ুন : বিশ্বের সেরা ১০ ভ্রমণ স্থান তালিকায় জনপ্রিয় জর্জিয়ার সাভানাহে

ওমেন্সকর্নার : সাহসিকতায় নিজেকে ১০ এ কত দিবেন ? 

তাসলিমা বাবলী :  আমার আম্মু বলে আমার কলিজা আমার থেকেও বড়! হাঃ হাঃ! আমি নিজেও বিশ্বাস করি আমি অনেকটাই সাহসী। দশে আট দেয়া যেতেই পারে।

ওমেন্সকর্নার : বর্তমানে অনলাইন ভিত্তিক অনেক ট্রাভেল গ্রুপ গড়ে উঠেছে। ' প্রকৃতিযাত্রী ' কেন অন্যদের থেকে আলাদা ?

তাসলিমা বাবলী :  প্রকৃতিযাত্রীকে আলাদা বলার অন্যতম কারণ হলো মেয়েদের সেইফটি এনসিউর করে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া। আমরা নিজেরা এই অব্দি ৮০+ ট্যুর এরেঞ্জ করেছি, তারমধ্যে ৬০% মেয়ে গেস্ট। এইটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। এরমধ্যে প্রচুর মেয়ে প্রকৃতিযাত্রীর সাথে ঘোরার আগে একা কোথাও ঘুরতে যায়নি। আমাদের ভরসা করে, বিশ্বাস করে একা চলে এসেছে। এমনকি অনেক মেয়েদের বাবা/মাও প্রকৃতিযাত্রীর সঙ্গে উনাদের মেয়ে ঘুরতে যাচ্ছে শুনলে চোখ বন্ধ করে অনুমতি দেন। 

ওমেন্সকর্নার : অনলাইন ভিত্তিক ট্রাভেল গ্রুপ নিয়ে নানান ধরণের নেগেটিভ কথা শোনা যায়। বিশেষ করে মেয়েদের সিকিউরিটি নিয়ে। বলা হয়ে থাকে অনেক গ্রুপ ঘুরতে যাওয়ার পর মেয়েদের সিকিউরিটি ঠিকভাবে দিতে পারছে না। আপনারা কিভাবে মেয়েদের সিকিউরিটির ব্যাপারটা  হ্যান্ডেল করছেন ?

তাসলিমা বাবলী :  আমি বা আমরা যখন প্রকৃতিযাত্রী শুরু করেছিলাম, তখন প্রথমেই মাথায় ছিলো "প্রকৃতিযাত্রী হবে মেয়েদের ঘোরার জন্য বিশ্বস্ত ট্র্যাভেল গ্রুপ।" এই ব্যাপারটা হয়েও গেছে অনেক আগেই। অধিকাংশ ট্যুরের লিডে আমি নিজে থাকি।

এছাড়া আমাদের হোস্ট প্যানেল কঠোরভাবে মেয়েদের সিকিউরিটি ইস্যু এনসিউর করে। কোনো ছেলে গেস্টের দ্বারাও যেন মেয়ে গেস্ট হ্যারাজড না হয় তারজন্য শুরুতে নির্দেশনা দেয়া থাকে এমন কোনো আচরণ করলে ওই ছেলে গেস্টকে সাথে-সাথে টিম থেকে বের করে দেয়া হবে।

আরো পড়ুন :  ভ্রমণের তৃপ্তি মিটাবে ইন্দোনেশিয়ার বালি

ওমেন্সকর্নার : নিজে মেয়ে এবং একইসাথে একজন ট্রাভেলার হয়ে কী ধরণের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন এবং হচ্ছেন ?

তাসলিমা বাবলী :  ট্র্যাভেলারদের নানান ধরনের প্রতিকূলতা থাকে, আমারো থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে, কেউ মেয়ে বলে বাজে কথা বলে দিলে। এছাড়া, আমাদের দেশে ট্র্যাভেল স্পটগুলোতে ওয়াশরুমের একটা বিশাল সমস্যা রয়েছে। আমি ম্যানেজ করতে পারলেও আমার সাথে থাকা মেয়ে গেস্টদের বেশ কষ্ট হয়ে যায়। 

ওমেন্সকর্নার : ট্রাভেলার বাবলীকে সবথেকে বেশি কোন প্রশ্নটা শুনতে হয় ?

তাসলিমা বাবলী :  "আপু, আপনি যে এতো ঘুরতে চান আপনার বাসা থেকে কিছু বলেনা?"

ওমেন্সকর্নার : ট্রাভেল গ্রুপের উদ্যোক্তা বাবলীর জন্য সবথেকে কঠিন পরিস্থিতি কী ছিলো ?

তাসলিমা বাবলী :  শুরু করা, মানে প্রকৃতিযাত্রী শুরু করা। নিজেরা যখন ঘুরতাম তখনকার ব্যাপারটা আলাদা ছিলো। ক'টা টাকা জমিয়ে কোথাও চলে যাওয়া যেতো। কিন্তু বাংলাদেশে থেকে ট্র্যাভেলিংকে প্রফেশান হিসেবে নিতে অনেক ভাবতে হয়েছে, অনেকবার পিছিয়ে যেতে হয়েছে। অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে। তারপর যখন প্রকৃতিযাত্রী হয়ে নিজের উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেছি, তখন আর কঠিন পরিস্থিতিকে আলাদা করে দেখেনি। প্রতিটা ব্যাপারকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।

আরো পড়ুন :  অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অপরুপ সৌন্দর্যের অধিকারী সিডনি

ওমেন্সকর্নার : বজরা এবং বিচ বাংলো নিয়ে একটু বিস্তারিত বলুন। 

তাসলিমা বাবলী :  "বজরা- দ্যা হাউজ বোট" টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রকৃতিযাত্রীর প্রথম হাউজবোট। এরআগে টাঙ্গুয়ার হাওরে আমাদের কাঠবডি এবং স্টিলবডির নৌকা ছিলো। কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম নতুন কিছু হোক! টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গায় হাউজবোট নেই। বোটের এই সমস্যায় অনেকেই হাওরে যেতে পারতেন না। আমরা চেয়েছিলাম এই সমস্যাটার সমাধান করতে। বজরা পুরোপুরি কাঠের তৈরি একটি হাউজবোট। এতে আলাদা কেবিন, হাইকমোড, চেঞ্জিং রুম, লাউঞ্জ, আইপিএস ইত্যাদি সকল-সুযোগ সুবিধাই রয়েছে।

"বিচ বাংলো" আমাদের সেইন্টমার্টিনের রিসোর্ট, প্রথম রিসোর্ট বলা যায়৷ কারণ ইতিমধ্যে বিচ বাংলো২ এর কাজ চলছে। বিচ বাংলোকে আমরা বাজেট ফ্রেন্ডলি রিসোর্ট হিসেবে গড়ে তুলেছি। আবার সেইন্টমার্টিনের গলাচিপায় অবস্থিত হওয়ায় বেশ শান্ত পরিবেশ চারদিকে। বিচ বাংলোর কাছেই পূর্ব এবং পশ্চিম বিচ দুটোই। ফলে বিচ বাংলোর অতিথিগণ সমুদ্রের বেশ সুন্দর রূপ উপভোগ করতে পারেন।

ওমেন্সকর্নার : ট্রাভেল নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলুন। 

তাসলিমা বাবলী :  আপাতত সব চিন্তাভাবনা বলুন আর পরিকল্পনা বলুন সবকিছু প্রকৃতিযাত্রীকে ঘিরেই। প্রকৃতিযাত্রীকে আরো বড় প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যাওয়া মূল লক্ষ্য। নিয়ে যেতে পারলেই বাংলাদেশের ট্র্যাভেলিংয়ে যেসব সুযোগ-সুবিধা নেই সেসব নিয়ে কাজ করবো ইন শা আল্লাহ্। মেয়েদের ট্র্যাভেলিং যাতে আরো সহজ হয় তা নিয়ে তো কাজ করবোই। ফরেইনার ট্র্যাভেলারগণ যেন বাংলাদেশে হরহামেশাই ঘুরতে আসেন, এটা নিয়েও কাজ করার ইচ্ছে আছে। আর নিজের জন্য টার্গেট হলো পৃথিবীর যতো জায়গায় সম্ভব হয় পদচিহ্ন রেখে আসা, এইতো।

আরো পড়ুন : ডাবলিন আয়ারল্যান্ড দ্বীপ

ওমেন্সকর্নার : যেসব মেয়েরা আপনার মতো প্রকৃতিপ্রেমী কিন্তু প্রকৃতি দেখার সুযোগ এবং সাহস পাচ্ছে না। তাদের উদ্দেশ্য কিছু বলুন। 

তাসলিমা বাবলী :  যেসব মেয়েরা প্রকৃতিপ্রেমী কিন্তু তাদের সুযোগ বা সাহস নেই তাদের জন্য আমার প্রথম কথা হলো আপনার ঘোরাঘুরি শুরু করুন। শুরু করার সাহসটা নিজেকেই অর্জন করতে হবে, আমারও এই সাহসটা অর্জন করতে সময় লেগেছিলো।

প্রথমে ডে ট্রিপ দিয়ে শুরু করতে পারেন, পরিবারকে বোঝাতে হবে আপনি একা ঘুরতে সক্ষম। পরিবারের বিশ্বাস এবং ভরসা অর্জন করার চেষ্টা করুন। আর যেকোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে তাসলিমা বাবলী এবং প্রকৃতিপ্রেমী আছে আপনাদের জন্য।

ওমেন্সকর্নার : যেহেতু ওমেন্সকর্নারে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। ওমেন্সদের উদ্দেশ্য করে আপনার কিছু বলা উচিত। আপনার দৃষ্টিতে আমাদের সমাজে নারীদের অগ্রগতি কতদূর ? নারীরা তাদের প্রাপ্ত সুযোগ - সুবিধা, সম্মান এবং মেধার যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে ? 

তাসলিমা বাবলী :  আমাদের সমাজে এখন বহু নারী চারদিকের কটু কথা, চোখ রাঙ্গানিকে উপেক্ষা করে নিজের পরিচয় তৈরি করতে চাচ্ছেন। চাকরি করছেন, ব্যবসা করছেন। আমাদের অগ্রগতি কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। তবে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, সম্মান এবং মেধার যথাযথ মর্যাদা আমরা এখনো পাচ্ছিনা। নারী বলে এখনো আমাদের ছোট করে দেখা হয়। তবে আমি আশা রাখি আমরা এই বিভেদ ভেঙ্গে দিবো। আমাদের সংগ্রাম যখন শুরু হয়েছে, তখন সমাজে সবাই একদিন মানুষ হিসেবেই সম্মান পাবে ইন শা আল্লাহ্।

ওমেন্সকর্নার : পাল্টা আরেকটি প্রশ্ন। অতীতের তুলনায় বর্তমানে নারীরা যথেষ্ট সুযোগ - সুবিধা পাচ্ছে। তারা এই সুযোগের সঠিক মূল্যায়ণ করতে পারছে ?

তাসলিমা বাবলী :  অতীতের তুলনায় বর্তমানে পাওয়া সুযোগ-সুবিধার সঠিক মূল্যায়ন এখনো অধিকাংশ নারীই করতে পারছেন না। এর পেছনে ভয়, গোঁড়ামো, পিছুটান, পরিবারের অসম্মতি, সমাজের নোংরা নিয়ম ইত্যাদি অনেককিছুই রয়েছে। এই সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করলেই সব নারীরা এগিয়ে যাবেন। ওমেন্সকর্ণারকে ধন্যবাদ নারীদের নিজেদের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে সচেতন করার জন্য৷ এরকম প্রতিষ্ঠান আরো অনেক তৈরি হলে অদম্য নারীদের দিয়ে পূর্ণ হবে বাংলাদেশ।

আরো পড়ুন :  ভীমবেটকা প্রস্তরক্ষেত্র

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment