‍‍`কিছু সংবাদকর্মী খবরের ফেরিওয়ালা থেকে খবরের চুরিওয়ালা হয়ে গেছে ‍‍`

  • ফারজানা আক্তার
  • আগস্ট ১১, ২০২১

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ একজন বিনোদন সাংবাদিক। আজকাল চারপাশের সবাই কমবেশি সাংবাদিক হয়ে উঠছেন। সংখ্যার দিক থেকে বিনোদন সাংবাদিকরা এগিয়ে আছেন। সস্তা শিরোনাম, নিউজের সাথে খোলামেলা ছবি, শিরোনামের সাথে বিস্তারিত নিউজের কোনো মিল নেই। 

চারপাশে যখন ক্লিকবেইট জার্নালিজমে ভরপুর ঠিক সে সময়ে মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ অন্যদের থেকে আলাদা। তার চিন্তা - ভাবনা, কাজের ধরণ প্রশংসনীয়। তবে বিনোদন সাংবাদিকের সাথে আমরা শুধু বিনোদন নিয়ে নয়, কথা বলবো পারিপার্শ্বিক নানান বিষয় নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারজানা আক্তার। 

ওমেন্সকর্নার : অস্থির এই সময়ে আপনি কতটা স্বস্তিতে আছেন ? 

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ : আমি মোটেও স্বস্তিতে নেই। খুব দমবন্ধ লাগে। প্রাণ খুলে ছুটতে পারি না। নানা প্রতিবন্ধকতা। আজ দুপুরে হঠাৎ করে স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ল। ক্লাস সেভেন এইটের সময়গুলোতে আমাদের প্রতিটি দিন ছিল উৎসবের মতো। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মার্চ মাস। আশপাশের স্কুল কলেজগুলোতে স্পোর্টস হতো। আমরা আট-দশ কিলো সাইকেল চালি যেতাম স্পোর্টস দেখতে যেতাম। 

কাউকে চিনি না, তারপর বিজয়ীর সাথে উল্লাসে মেতে উঠলাম। এছাড়া মার্চমাসে হঠাৎ হঠাৎ গরম বাতাস বয়ে যেত। তাতে স্কুলের মেহগনি গাছ থেকে বৃষ্টির মতো পাতা ঝরত। কে কোন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়বে, নতুন ক্লাসে কার সাথে কতটা গল্প জমল, নতুন কোন স্যার কেমন এসব নিয়ে সারাক্ষণ আলোচনা করতাম। এখনকার শিক্ষার্থীরা সেই উৎসবটা মিস করে গেল। এরা আর জীবনে এইট নাইনের ক্লাস পাবে না , এই ভাবনাটা আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছিল। কবে এইসব শেষ হবে, কবে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলব তাই ভাবছিলাম।

ওমেন্সকর্নার : বিনোদন সাংবাদিকরা আমাদের কতটুকু সুস্থ বিনোদনের নিউজ দিতে পারছে বলে আপনি মনে করেন। 

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ : আমি খুবই হতাশ। হাতে গোনা কয়েকটা পত্রিকা/পোর্টাল ছাড়া বাকি সবাই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। হিট পাওয়ার আশায় তারা যা দিচ্ছে তা সুস্থ বিনোদন তো নয়ই বরং দুষ্টু বিনোদন বলা যায়। 

আরো পড়ুন : আপনার শিশুকে বাধ্য করবেন যেভাবে

ওমেন্সকর্নার : আপনার দৃষ্টিতে বিনোদন সাংবাদিকতা কেমন হওয়া উচিত ?

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ : বহির্বিশ্বে বিনোদনের নিউজ ছাপা হয় পত্রিকার তিন নাম্বার পাতায়। প্রথম আর শেষ পাতার পরই কিন্তু তিন নাম্বার পাতার গুরুত্ব। আপনি প্রথম পৃষ্ঠা উল্টালেই তৃতীয় পাতা পাবেন। এই পাতাকে বলা হয় ‘পেজ থ্রি’। পত্রিকার ভাষায় পেজ থ্রি একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। ক্যাটাগরি বিচারে নিউজের দুইটা ধরণ আছে। হার্ড নিউজ, সফট নিউজ। বিনোদনের নিউজ সফট নিউজের কাতারে পড়ে। 

তারমানে সাংবাদিকতার অন্য যে নীতিমালা তার সঙ্গে সফট নিউজের সম্পর্ক কম। এই সুযোগটা নিয়ে এখনকার বিনোদন সাংবাদিকরা যা ইচ্ছা করছে। এটা মোটেও উচিত না। পেজ থ্রিতে অবশ্যই মজার, আনন্দের, বিনোদনের, শিল্পের নিউজ থাকবে। তাই বলে সাংবাদিকতার বেসিক নীতি ভুলে যাবে না। অবশ্যই নীতিমালা ও শালীনতা মেনে বিনোদনের খবর প্রকাশের মানসিকতাই বিনোদন সাংবাদিকতা হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।  

ওমেন্সকর্নার : সাম্প্রতিক এক নায়িকাকে কেন্দ্র করে প্রথম সারি পত্রিকা থেকে শুরু করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো পত্রিকাও সারাক্ষণ যেভাবে নিউজ করছে। এই বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন ? 

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ : এটা আসলে দেখার মতো বিষয় না। আমি দেখিই না বলা চলে। কয়েকটা স্বনামধন্য পত্রিকার ওয়েব পোর্টালে গিয়ে দেখি ১৫টা নিউজের ১৪টাই সেই নায়িকাকে নিয়ে। যেসব নিউজের না আছে ভিত্তি, না আছে নিউজভেলু। পাঠক মজা পাবে বলেই নিউজগুলো করা। এসব দেখে আমি যারপরনাই বিরক্ত।  

আরো পড়ুন : প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার: প্রথম বিপ্লবী নারী শহীদ ব্যক্তিত্ব

ওমেন্সকর্নার : সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতা বলতে আমরা যা বুঝি আর বর্তমানে যা হচ্ছে দুইটার মধ্যে প্রধান পার্থক্য কোথায় ?

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ : বিস্তর পার্থক্য। এখন সাংবাদিকতার ক্ষেত্র বেড়েছে। পাঠকও বেড়েছে। আগে একটা নিউজ পড়লে পাঠক সেটার প্রতিউত্তর করতে পারত না। এখন নিউজের নিচে কমেন্ট করার জায়গা থাকছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা পার্থক্য। মিডিয়া হাউজগুলো যদি নিচের কমেন্টগুলোর মূল্যায়ন করত তাহলে এখনকার সাংবাদিকতা অনেকটাই পরিশুদ্ধ হতো। 

কিন্তু পদস্থ সংবাদকর্মীদের গায়ের চামড়া গণ্ডারের চামড়ার মতো হয়ে গেছে। পাঠকদের গালাগালিকেও তারা সাইটের এঙ্গেজমেন্ট হিসেবে দেখছে। আর আগে দেখেছি কোনো নিউজ নিয়ে কেউ আপত্তি করলে সেটা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করা হতো। সাংবাদিকতা বলতে আমরা যে খবরের ফেরিওয়ালাকে বুঝি এখন সেই ফেরিওয়ালা নেই। দেখবেন, একটা নিউজ একটা ওয়েব পোর্টালে আসার দশ মিনিটের মধ্যে দেশের সব পোর্টালে চলে এসেছে। এরা খবরের ফেরিওয়ালা থেকে খবরের চুরিওয়ালা হয়ে গেছে।  

ওমেন্সকর্নার : একজন বিনোদন সাংবাদিক হিসেবে আপনি নিজে নিজেকে ১০ এর মধ্যে কত দিবেন ?

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ :  ২.৫ দিব। তারমানে ফেল। বর্তমান বিনোদন সাংবাদিকতার গুণ(!) হিসেবে যা ধরা হয় তার কোনোটাই আমার নেই। বর্তমান বিনোদন সাংবাদিকরা তারকাদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরিতে তৎপর। একজন তারকার সাথে দেখা হলেই সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করার ধান্দায় থাকে সবাই। সে মনে করে, এতে করে তার ওয়েট বেড়ে গেল। কিন্তু একজন তারকার সঙ্গে যদি আমার গভীর সম্পর্ক থাকে, এই তারকা যখন ভুল করবে সেই রিপোর্ট প্রকাশে আমি একটু হলেও বায়াসড হয়ে যাব। 

আমি তারকাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক করি না, তারকাদের জন্মদিন, এটা সেটায় তেলতেলিয়ে প্রশংসা করি না, নিউজ গুরুত্বপূর্ণ হলে আমার অপছন্দের ব্যক্তির নিউজ ছাপাই, গুরুত্বপূর্ণ না হলে পছন্দের ব্যক্তিরও নিউজ করি না। ফলে আমি আসলেই বিনোদন সাংবাদিক হয়ে উঠতে পারিনি। 

প্রশ্ন করতে পারেন তাহলে ২ দশমিক ৫ মার্ক কেন দিলাম? আসলে আমার শত্রুরাও আমার লেখার প্রশংসা করে। একজন বস পেয়েছিলাম। তিনি আমার চাকরি খাওয়ার জন্য বহু চেষ্টা তদবির করছিলেন। তিনিও একদিন আমার অবর্তমানে বলছিলেন, ‘আর যাই হোক, শালার বাংলা লেখা খুবই ভালো।’ তার কথার উপর ভিত্তি করেই দশে নিজেকে আড়াই দিয়েছি।   

আরো পড়ুন : মনোবিজ্ঞানী এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মধ্যে পার্থ্যক কী ?

ওমেন্সকর্নার : বিনোদন সাংবাদিকতা যারা করতে চায় এবং নতুন যারা এসেছে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন। 

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ : প্রথমত যার বিনোদন সাংবাদিকতায় ভালো জানাশোনা আছে, মানে যে ছোটবেলা থেকেই বিনোদন পেজ গুরুত্ব দিয়ে পড়ে তারই বিনোদন সাংবাদিকতায় আসা উচিত। নতুন যারা এসে গেছে তাদের বলবো আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে বেশ কিছু ভালো বই আছে সেগুলো পড়া উচিৎ। শুধু বর্তমান জানলে হবে না, আমাদের সোনালী অতীতও জানতে হবে। তাহলে কাজের ক্ষেত্রে নানা সুবিধা হয়। এছাড়া বিনোদনের যেই জগত নিয়ে সে কাজ করতে চায় তার আদ্যোপান্ত খবর রাখতে হবে। তারমানে এই না, আমি সব জেনে গেছি। আমি জানার প্রসেসে আছি। নতুনরাও এই প্রসেসে থাকলে ভালো করবে। 

ওমেন্সকর্নার : আপনি নিজে একজন লেখক। নিজের লেখালেখি সম্পর্কে কিছু বলুন। 

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ :  আমি আগে লেখক, পরে সাংবাদিক। সাংবাদিক হতে এসে লেখক হইনি। বরং লেখক হতে এসে সাংবাদিক হয়েছি। তবে ব্যস্ততার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে সবকিছু। লেখালেখির জন্য অনেক পড়া উচিত। পড়া হচ্ছে না। লিখতে পারছি না।

প্রতি বছর একটা বই করে নিজেকে লেখক বলা যায় না। একটা বইয়ে যখন গভীর চিন্তা, দর্শন ও সময় উঠে আসে তখন কেউ নিজেকে লেখক বলতে পারেন। ব্যস্ততার ভেতর বই লিখে এগুলো কাভার করতে পারি না। তবে পরিকল্পনা আছে, একসময় সব ছেড়ে ছুড়ে জীবন-যাপনে লেখক হয়ে যাওয়ার। তখন হয়তো নিজের লেখালেখি সম্পর্কে বিস্তর বলতে পারব। 

ওমেন্সকর্নার : আপনার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে সাহিত্য জগতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কিছু বলুন।

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ :  বর্তমান সাহিত্যের অবস্থা হয়েছে বিনোদন পাতার মতো। পাঠক যা চায় তাই দিতে উঠে পড়ে লেগে আছে সবাই। পাঠককে প্রভাবিত করে নতুন চিন্তার রস যোগানোর চেষ্টা কম লেখকেরই আছে। 

আরো পড়ুন : আপনার বাচ্চার সৃজনশীলতা জাগিয়ে তুলতে জেনে নিন ৪টি স্পেশাল টিপস

ওমেন্সকর্নার : সাংবাদিকতা এবং লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ ভাবনা কী ?

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ :  ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক ভাবি আমি। শুধু এটা জানি না, ভবিষ্যৎটা পাব কি না। তাই ভবিষ্যৎ ভাবনাটাকে ভাবনার জায়গায় রেখে দেই। আর সেখানে পৌঁছানের চেষ্টা করি। দোয়া করবেন, ভাবনাগুলো ধরা দিলেই জানতে পারবেন, হয়তো একদিন সবাইকে বলবোও, আমার ভাবনায় কী ছিল, কতটুকো করতে পেরেছি। 

ওমেন্সকর্নার : যেহেতু ওমেন্সকর্নারে ইন্টার্ভিউ দিচ্ছেন। ওমেন্সদের উদ্দেশ্য করে আপনার কিছু বলা উচিত। আপনার দৃষ্টিতে আমাদের সমাজে নারীদের অগ্রগতি কতদূর ? নারীরা তাদের প্রাপ্ত সুযোগ - সুবিধা, সম্মান এবং মেধার যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে ? 

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ : এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। সম্মান, সুযোগ-সুবিধা, মর্যাদা শব্দগুলো কিন্তু আপেক্ষিক। আপনার কাছে যেটা মর্যাদার আরেক জানের কাছেই সেটা কিন্তু অমর্যাদার মনে হতে পারে। কেননা এই শব্দগুলোর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাখ্যা এখনো দাঁড়ায়নি। কখনো দাঁড়াবে বলে মনে হচ্ছে না। সমাজের নারীরা অনেক এগিয়েছে এটা যেমন সত্য, নারীর প্রতি অমর্যাদা, সহিংসতা, নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার ততই বেড়েছে।

আমার মনে হয় নারী যতদূর এগিয়েছে, পিছিয়েছেও ততদূর। পিছিয়ে দেওয়া হয়েছেও বলা যায় নির্দ্বিধায়। কেননা নারীরা নিজে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। যারা নারী অধিকারের কথা বলে সমাজের সকল স্তরের নারীর হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তারা জানে না সমাজের সকল স্তরের নারী কী চায়? আমার ভাবনা ভুলও হতে পারে। 

আরো পড়ুন : ‍‍`আমাদের পরিবার প্রথা ও বিষাক্ত প্যারেন্টিং‍‍

ওমেন্সকর্নার : পাল্টা আরেকটি প্রশ্ন। অতীতের তুলনায় বর্তমানে নারীরা যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। তারা এই সুযোগের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছে ?

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ :  বেশিরভাগই পারছে। অল্প কিছু এই সুযোগ সুবিধার অপ-ব্যবহার করছে। তাদের এই অপ-ব্যবহারটা আবার প্রচার হচ্ছে বেশি। এই সুযোগ নিচ্ছে স্বার্থন্বেষী পুরুষেরা। তারা নারীর অগ্রযাত্রা রুখে দিতে এই টার্মগুলো সামনে নিয়ে আসছে। ফলে বাকি নারীরা এই সুযোগের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে।
 

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment